travel-kashmir

ভূস্বর্গ কাশ্মীরে পাঁচদিন
সুমনা সাহা

চিত্র-১> শ্রীনগর থেকে পেহেলগাঁও যাওয়ার পথের দৃশ্য লেখকের ক্যামেরায়

আমরা যে সময়টায় বড় হয়ে উঠেছি, তারও অনেক আগে থেকে কাশ্মীর নিয়ে নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েন। কিন্তু তবুও লোকে যে কাশ্মীরে বেড়াতে যেত না, এমন নয়। তবে আমাদের ছেলেবেলায়, অর্থাৎ ৭০-এর দশকে, কাশ্মীর-ট্যুরিজম তুঙ্গে। শাম্মি কাপুরের জংলি, কাশ্মীর কি কলি ইত্যাদি সিনেমা আপামর ভারতবাসীকে আবেগে ভাসিয়ে দিচ্ছে। মনে পড়ে আমরা ছোটরা অবসরের বেলায় দোতলার সিঁড়ির উপর থেকে একতলার ল্যান্ডিং-এ ‘জংলি’ স্টাইলে ‘ইয়া হু’ বলে লাফ দিয়ে পড়তাম। কিন্তু আমাদের ছিল বড় পরিবার, সকলকে নিয়ে অতদূর ভ্রমণের খরচ ও আনুষঙ্গিক নানা অসুবিধার কথা ভেবেই হয়তো কোনদিন কাশ্মীরে বেড়াতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। পরবর্তী সময়ে কাশ্মীরে আতঙ্কবাদী কর্মকাণ্ড আরম্ভ হল, অগ্নিগর্ভ ভূস্বর্গ পর্যটকদের কাছে ত্যক্ত হল। কিন্তু ১৯৮৯ সালের আগে পর্যন্ত, ভারতীয় শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে কাশ্মীর উপত্যকায় সশস্ত্র আন্দোলন আরম্ভ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় পর্যটক তথা সাগরপারের বিদেশী পর্যটকরা এই ভূস্বর্গে দলে দলে এসে ভীড় করেছে। ১৯৮৭ সালের একটি সরকারি সার্ভে রিপোর্ট অনুসারে, সেবছর কাশ্মীর-ভ্রমণে এসেছিল সাত লক্ষ পর্যটক। এর ঠিক তিন বছর পর, ১৯৯০-এ প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়ে গেল। কাশ্মীরে আতঙ্কবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভ্রমণার্থীর সংখ্যা কমে ৬০০০-এ নেমে আসে। এর কারণ এবং আমাদের বর্তমান ভ্রমণ কীভাবে সম্ভব হল, তা বলতে হলে কাশ্মীরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পুরনো ইতিহাস একটু স্মরণ করতে হবে।

ইস্ট-ইন্ডিয়া কম্পানি হিসেবে ব্রিটিশ শাসনকালে এবং তারপরে কম্পানির শাসন ব্রিটিশ-রাজ অধিগ্রহণ করার পরেও, ১৮৪৬ সাল থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভ, অর্থাৎ ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় শতাধিক বছর জম্মু-কাশ্মীর ছিল স্থানীয় রাজাদের দ্বারা শাসিত রাজ্য (প্রিন্সলি স্টেট)। অ্যাংলো-শিখ যুদ্ধের পর থেকেই প্রিন্সলি স্টেট গঠিত হয়েছিল। ভারত-পাকিস্তান দেশভাগ তথা ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের পর, জম্মু-কাশ্মীরের তৎকালীন মহারাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে থাকবেন, নাকি পাকিস্তানের অঙ্গীভূত হবেন, এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধায় পড়েছিলেন। অবশেষে, ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর, মহারাজা হরি সিং এই শর্তে জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতের অঙ্গীভূত রাখতে স্বীকৃত হলেন, যে, ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় জম্মু-কাশ্মীরে যে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করতে হবে, জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের থাকবে নিজস্ব পৃথক পতাকা, এবং রাজ্যের আভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থায় থাকবে রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ, অর্থাৎ স্বায়ত্তশাসন। এই সমস্ত শর্ত ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকেল নং-৩৭০-এ নথিভূক্ত করা হয় এবং জম্মু-কাশ্মীর ভারতের রাজ-শাসিত রাজ্য হিসেবে থেকে যায়।

১৯৯০ সাল নাগাদ পরিস্থিতি আমূল বদলে গেল। শান্ত পাহাড়ি উপত্যকার বাজারে, অলিতে গলিতে বন্দুকধারী মিলিটারিদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত। প্রায় প্রত্যেকদিন গভীর রাত্রে সারি সারি সেনা-কনভয় টহল ও গোলাগুলি-গ্রেনেড বিনিময় নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমির উপর বিছিয়ে দিল আতঙ্কের চাদর। একদা ‘ভূস্বর্গ’ নামে অভিহিত এই রাজ্য পরিণত হল বিশ্বের একটি ‘সেনা-অধ্যুষিত’ অঞ্চলে। যারা কেবল ভ্রমণার্থীদের অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করত, সমস্ত সঞ্চিত পুঁজি ফুরিয়ে গেলে তারা অন্য পেশা বেছে নিতে বাধ্য হল। কেউ কেউ কাশ্মীরী শাল নিয়ে ব্যবসার আশায় এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে লাগলো, অনেকে নতুন জীবিকার সন্ধানে উপত্যকা ছেড়ে দিল্লী বা বম্বে পাড়ি দিল।

আবার প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হল ৬ আগস্ট, ২০১৯, জম্মু-কাশ্মীরের ইতিহাসে ঐদিন যোগ হল এক নতুন অধ্যায়। ৩৭০ নং আর্টিকেলটি ভারতীয় সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া হল, পশ্চিমে জম্মু ও কাশ্মীর, এবং পূবে লাদাখ, মোট দুটি প্রশাসনিক বিভাগ (ইউনিয়ন টেরিটরি) হল।

কিন্তু ঐ বছরেরই নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস থেকে গোটা পৃথিবীকে অন্য এক ভয় শাসন করে গৃহবন্দী করে ফেলল, সে হল মহামারি করোনা। ২০২০-র মাঝামাঝি প্রায় সমগ্র বিশ্বই অচলাবস্থায় এসে গেল। সেই মহামারীর অভিশাপ কাটিয়ে রেলপথ, বিমানপথ আবার রুদ্ধদ্বারের আগল খুলল ২০২১-এর শেষাশেষি, ২০২২-এ এসে করোনার আতঙ্ক থেকে মুক্তির শ্বাস নিয়ে নতুন সাবধানতা সহ মানুষ ফিরছে পুরনো ছন্দে, আর এই অবসরেই আমাদের কাছে হঠাৎ উপস্থিত হল শ্রীনগর যাওয়ার একটা সুযোগ। শৈশবলালিত সুপ্ত স্বপ্নের ঝাঁপি খুলে গেল। আমরা মহানন্দে কাশ্মীর ভ্রমণের ব্যাগ-প্যাক করতে লেগে পড়লাম। মুখ্য উদ্দেশ্য ভ্রমণ, কেজো উদ্দেশ্যটি একটি অফিসিয়াল মিটিং।


দিন- ১; শ্রীনগরের শ্রী দর্শন: শঙ্করাচার্য মঠ, শালিমার বাগ, শিকারা-ভ্রমণ


শ্রীনগর এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখি চারদিকে প্রচুর সেনা, এমনকি টয়লেটের সামনেও। ভারতে ও দেশের বাইরের বিভিন্ন এয়ারপোর্টের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মনে হল আধুনিকতায় এখনও অনেকখানি পিছিয়ে। আমাদের জন্য গাড়ি পাঠানো হয়েছে। আমরা হাউজবোটে ‘সামান’ রেখে লাঞ্চ সারলাম মিটিং-ভেন্যুর গেস্ট হাউসে। তারপর সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম সাইট-সিইং-এ।

একটা দুধ-সাদা ইনোভা গাড়ি আমাদের জন্য বরাদ্দ হল। আমাদের সঙ্গে ঐ গাড়িতে সফর-সঙ্গী হলেন মিটিং-এ আগত বয়স্ক এক গুজরাটি দম্পতি। ওঁরা সত্তরোর্ধ্ব জুটি, অতএব খানিক নিস্তরঙ্গ। ভ্রমণ-কাহিনী লেখার টানে আমার উৎসাহ একটু বেশি, তাই সবকিছু ভালভাবে দেখব বলে সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলাম। যেতে যেতে ‘এটা কি?’ ‘ওই রাস্তাটা কোন দিকে গেছে?’ ‘এখানে লাল্লা যোগেশ্বরীর সমাধিটা কোথায়?’ ‘পশমিনা কোথায় ভাল পাওয়া যায়?’ ‘এখানে স্পেশাল খানা কী?’ ইত্যাদি নানা প্রশ্নোত্তরের মধ্যে দিয়ে সারথী শওকত খান-এর সঙ্গে বেশ ভাব জমে উঠল। ও বলল, “ম্যাডামজী, আপ মেরে সাথ আলগ সে ঘুমনে চলো, পুরানি জাগা দিখায়েঙ্গে আপকো। সারাদিন ঘুমোগে, আপ যাহা চাহো লে যায়েঙ্গে, মুঝে সাড়ে তিন হাজার দে দেনা, ঠিক হ্যায়?” বললাম, “দেখতে হ্যায়, আগর টাইম মিলা তো একদিন গ্রুপ সে আলগ হোকে ঘুমনে চলেঙ্গে।”


প্রথম গন্তব্য— শঙ্করাচার্য মঠ


জাবারওয়ান পর্বতমালার শঙ্করাচার্য পাহাড়ে প্রায় ১১০০ ফুট উঁচুতে ভগবান শিবের মন্দির। লোকের বিশ্বাস, এখানে আচার্য শঙ্কর ভগবান শঙ্করের সাক্ষাৎ দর্শন পেয়েছেন। নিচে সেনা প্রহরা, উপর পর্যন্ত গাড়ি যায় না। পাহাড়ে ওঠার আগে গাড়ি থামিয়ে সেনাবাহিনীর জওয়ানরা জিজ্ঞাসাবাদ করেন, আই-কার্ড দেখেন, তারপর কিছুটা গিয়ে গাড়ি রেখে হেঁটে উপরে যেতে হয়, চড়তে হয় প্রায় ২৫০ সিঁড়ি! খুবই কষ্টকর, কিন্তু পৌঁছানোর পর উপর থেকে ডাল লেক সহ সমস্ত শ্রীনগরের ৩৬০ ডিগ্রী অসাধারণ ভিউ দেখে সব কষ্ট লাঘব হয়ে যায়।

মূলত এটি জ্যেষ্ঠেশ্বর শিবমন্দির। এই মন্দির কত প্রাচীন, তা বলা শক্ত। হিন্দুরা তো বটেই, এমনকি মুসলমান ও বৌদ্ধ ধর্মবিশ্বাসও জড়িয়ে আছে এই মন্দিরের ইতিহাসে। মহাশিবরাত্রি, স্থানীয় কোশুর ভাষায় ‘হেরাথ’-এর দিন কাশ্মীরী হিন্দুরা এই মন্দিরদর্শনে অবশ্যই আসেন। মন্দির ও সংলগ্ন পার্বত্য এলাকা ভারত-সরকারের আর্কিওলজিকাল সার্ভে-র তত্ত্বাবধানে রয়েছে। উনিশ শতক থেকে ধর্মার্থ ট্রাস্ট এটি দেখভালের দায়িত্বে আছেন। অনেকের মতে এটাই কাশ্মীরের প্রাচীনতম মন্দির। এই পাহাড় ও মন্দিরের প্রথম উল্লেখ পাওয়া গেছে কাশ্মীরী পণ্ডিত কলহনের রাজতরঙ্গিনী-তে। তিনি এই পাহাড়কে গোপাদ্রি (গোপ+অদ্রি) নামে উল্লেখ করেছেন, রাজা গোপাদিত্য আর্যাবর্ত থেকে আগত ব্রাহ্মণদের এই গোপ পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসের অনুমতি দেন এবং ৩৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনিই গোপ পাহাড়ের চূড়ায় জ্যেষ্ঠশ্বর শিবমন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। তাহলে এটি শঙ্করাচার্য মঠ হল কেমন করে? এ নিয়ে আছে একটি কাহিনী, আচার্য শঙ্করের জীবনীগ্রন্থ, ‘শঙ্করদিগ্বিজয়’-এ তার উল্লেখ আছে।

তখন সারা ভারত জুড়ে বৌদ্ধধর্মের প্রবল প্রভাব। বৌদ্ধরা বেদ মানে না। সনাতন বৈদিক মত প্রতিষ্ঠা ও বেদান্ত মত প্রচার করবার জন্য শঙ্কর সমগ্র ভারত ভ্রমণ করে পণ্ডিতদের তর্কযুদ্ধে আহ্বান করতেন। তর্কযুদ্ধের শর্ত থাকত—হার হলে মেনে নিতে হবে শঙ্করের মত, নতুবা প্রাণবিসর্জন দিতে হবে। কিন্তু বৌদ্ধধর্মের রমরমার মধ্যেও শৈবসাধনার এক অন্তর্লীন ফল্গুধারা কাশ্মীরে সদা প্রবাহিত ছিল। স্বামী পরমহংস যোগানন্দ তাঁর ‘অটোবায়োগ্রাফি অব আ যোগী’ গ্রন্থে লিখেছেন, আমাদের পুরাণগুলিতে হিমালয়কে যোগীরাজ মহাদেবের বাসভূমি বলা হয়েছে। মহাকবি কালিদাসের কাব্যিক বর্ণনায় হিমালয় হল শিবের অট্টহাসি। সেই সময়কার এক পণ্ডিত বাসুগুপ্তকে শিব স্বয়ং দর্শন দিয়ে ‘শিবসূত্র’ উপদেশ করেছিলেন। সেই শিবসূত্র পাহাড়ের পাদদেশে একটি বড় শিলায় খোদিত আছে। কাশ্মীরী শৈবমতে শিবশক্তি অভেদ তত্ত্ব স্বীকৃত। শঙ্করাচার্যকে লোকে সাক্ষাৎ শিব বলত, অথচ স্বামী বিবেকানন্দের মতই, প্রথম দিকে তিনি শক্তি মানতেন না। শ্রীরামকৃষ্ণ যেভাবে নরেনকে ‘কালী’ মানিয়েছিলেন, সেভাবেই একটি ঘটনায় শঙ্করের দৃষ্টির একপেশে ভাব ঘুচে গিয়েছিল বলে লোকের বিশ্বাস।

ভারতীয় সন্ন্যাসী সম্প্রদায় নিরগ্নি, তাঁরা আগুন জ্বেলে রান্না করেন না। তাই তাঁদের ভিক্ষান্নই ভরসা। কিন্তু কাশ্মীরে প্রবেশের মুখে শঙ্কর বাধাপ্রাপ্ত হলেন, ফলে শ্রীনগরের বাইরে সশিষ্য ঘাঁটি গাড়লেন। এদিকে শহরের ভিতরে প্রবেশ করতে না পারলে গৃহস্থের কাছ থেকে ভিক্ষা মিলবে না। ক্ষুধায় কাতর শঙ্করের সামনে একদিন সন্ধ্যার মুখে একটি কুমারী মেয়ে উপস্থিত হল। সে বলল, “তুমি যখন এতই জ্ঞানী, আগুন নিজেই তৈরি করে নিচ্ছ না কেন?” শঙ্কর বালিকার কথায় মানসিক ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। তখন ঐ বালিকা একটি কাঠের উপর আরেকটি কাঠ রেখে সামান্য ঘষে আগুন বের করে ফেলল আর হাসতে হাসতে চলে গেল। শঙ্করের একটি দিব্য অনুভূতি লাভ হল। তিনি উপলব্ধি করলেন, শক্তি বিনা শিব কোন কার্যসাধনে অক্ষম। তিনি শিবের সঙ্গে শক্তিরও প্রাধান্য স্বীকার করলেন। অবশেষে নগরে প্রবেশাধিকার পেলেন এবং শোনা যায় ঐ পাহাড়ের চূড়ায় বসে তিনি রচনা করেন বিখ্যাত ‘সৌন্দর্যলহরী’ স্তোত্র। শক্তিশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত বিখ্যাত কুণ্ডলিণী-স্তুতি ‘পঞ্চস্তবী’ রচনাকার পণ্ডিত গোপী কৃষ্ণ শঙ্করের পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হলেন। শঙ্কর কাশ্মীরে জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান শারদা মন্দির দর্শনে উপস্থিত হলে তাঁকে ‘শারদাপীঠ’-এ আসন দান করে শ্রেষ্ঠ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। শ্রীনগরের দক্ষিণ-পশ্চিম ভাগ থেকে ১০০ কিমি দূরে এই স্থানটি বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত। শুধু এই সম্মান দান করেই কাশ্মীরী পণ্ডিতরা তৃপ্ত হলেন না, যে স্থানে বসে এই পণ্ডিত অতিথি অসাধারণ ‘সৌন্দর্যলহরী’ স্তোত্র রচনা করেছেন, তাঁকে তাঁরা শিবমন্দির সমেত সমগ্র গোপাদ্রি পাহাড়টাই উৎসর্গ করলেন। সেই থেকে এটি শঙ্করাচার্য পাহাড় ও শঙ্করাচার্য মন্দির নামে বিখ্যাত হল।

মন্দিরটি প্রায় ২০ ফুট লম্বা একটি অষ্টকোণ পাথরের ভিত্তির উপর স্থাপিত, এই অষ্টভূজের প্রত্যেক পাশ ১৫ ফুট চওড়া। ২১ ফুট ব্যাসের একটি বৃত্তাকার পাথরের উপর মন্দিরের মধ্যভাগ। প্রবেশদ্বার সাড়ে তিন ফুট চওড়া ও মন্দিরের দেওয়ালের দৈর্ঘ্য আট ফুট। মন্দিরের ভিতর দিকে দুটি পাথরের দেওয়ালের মাঝখান দিয়ে ছাদে উঠবার পাথরের সিঁড়ি, যার উল্টোদিকে অন্ধকার ও ছোট একটি গোলাকার গর্ভগৃহে রয়েছে পাথরের সর্পবেষ্টিত শিবলিঙ্গ। নিত্য পূজা হয় এখানে। অমরনাথ তীর্থযাত্রীরা এই মন্দির দর্শন করে যাত্রা আরম্ভ করেন।

চিত্র-২, উইকিমিডিয়া কমনস > দূর থেকে দৃশ্যমান পাহাড়ের চূড়ায় শঙ্করাচার্য মন্দির

ডোগরা বংশের রাজত্বকালে রাজা গুলাব সিং (১৭৯২-১৮৫৭) পাহাড়ের উপর থেকে নিচে দুর্গানাগ মন্দির পর্যন্ত সিঁড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। পরে এই সিঁড়ি ঝিলাম নদী পর্যন্ত নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু পাথর মসজিদ তৈরি করার সময় সিঁড়ির পাথরগুলো নূর জাহানের আদেশে খুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯২৫ সালে মাইসোরের মহারাজা কাশ্মীর ভ্রমণে এসে এই মন্দিরে বৈদ্যুতিক সার্চ লাইটের ব্যবস্থা করেন, সিঁড়ির নিচ থেকে উপর পর্যন্ত পাঁচটি এবং মন্দির শীর্ষে একটি। তিনি ইলেকট্রিসিটির খরচ বহনের জন্য একটি ফান্ডও জমা করে গিয়েছিলেন। ১৯০৩ সালে ঋষি অরবিন্দ এই মন্দির দর্শন করতে এসেছিলেন। ১৯৭৪ সালের রাজেশ খান্না ও মুমতাজ অভিনীত বলিউড সিনেমা ‘আপ কি কসম’-এর বিখ্যাত গান ‘জয় জয় শিব শঙ্কর’-এর ভাঙ খেয়ে নাচের দৃশ্যের খানিকটা এই মন্দির-এলাকায় শ্যুটিং হয়েছিল। ‘মিশন কাশ্মীর’ সিনেমায়ও এখানকার দৃশ্য দেখানো হয়েছে।

জম্মু-কাশ্মীর একাডেমি রেকর্ডস প্রকাশিত ‘কোশুর এনসাইক্লোপিডিয়া’-তে আছে—“গোপাদ্রির শিবলিঙ্গম-এর পিছনে দ্বারকাপীঠ-এর শঙ্করাচার্য কর্তৃক ১৯৬১ সালে শঙ্করাচার্য-এর বর্তমান মূর্তিটি স্থাপিত হল, এই মন্দির কাশ্মীর তীর্থে আগত প্রত্যেক পণ্ডিত, দার্শনিক, মরমীয়া সাধক, কবির অবশ্য দর্শনীয়। এটি লিখতে গিয়ে আমার এক কাশ্মীরী কবির উদ্ধৃতি মনে পড়ছে—

‘উদ্যান ও বৃক্ষরাজি ধ্বংস করতে আসে যে, তাকে তাড়িয়ে দাও। এমন মধুর বাণী বলো, যেন হৃদয় গান গেয়ে ওঠে, এসো, আগামীকালের কাজগুলো আমরা আজই সেরে ফেলি। আমাদের বিবর্ণ ভাগ্যের শুশ্রূষা করি, কারণ আজকের দিনটাই তো আগামীকালের সূর্য-র ধাত্রীমা!”

দ্বিতীয় গন্তব্য— শালিমার বাগ

চিত্র-৩> শালিমার বাগ, শ্রীনগর, ফটোস্বত্ব-লেখক

পৌঁছলাম কাশ্মীরের বিখ্যাত মুঘল-বাগিচাগুলোর অন্যতম শালিমার বাগ। কিন্তু এর ইতিহাস অনেক প্রাচীন। দ্বিতীয় শতকে শ্রীনগরের তৎকালীন শাসক দ্বিতীয় প্রভাসেনের উদ্যোগে এই বাগানের জন্ম। ৭৯ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৩৯ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রভাসেন এই অঞ্চল শাসন করেছেন। ডাল লেকের উত্তর-পূর্ব কোণে বসবাসের জন্য তিনি একটা কুটির নির্মাণ করে নাম দেন শালিমার, যার অর্থ ‘ভালবাসার বাসা’। সৌন্দর্য পূজারী সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রিয়তমা পত্নী নূরজাহানকে উপহার দেওয়ার জন্য ১৬১৯ সালে এই প্রাচীন বাগিচাটি নতুন করে সংস্কার ও পরিবর্ধন করান। নাম দিয়েছিলেন, ‘ফারাহ বকশ’, যার মানে আনন্দময় স্থান। সত্যিই আনন্দময় বটে। পাহাড়ের ঢালে ঘন সবুজ মখমলের মত ঘাসের গালিচা, রঙবেরঙের হাজার ফুল, প্রাচীন চিনার গাছের সারি আর পাহাড়ি ঝর্নার কলতান—সব মিলিয়ে সত্যিই মর্ত্যের বুকে যেন এক টুকরো স্বর্গ! পরে ১৬৩০ সালে, জাহাঙ্গীর পুত্র সম্রাট শাহজাহানের আমলে সম্রাটের আদেশে কাশ্মীরের শাসক জাফর খান এই বাগিচা আরও সম্প্রসারিত করে এর নাম দেন ফয়েজ বকশ, অর্থ প্রচুর গাছগাছালিতে সমৃদ্ধ। জাফর খানের অনুগামী পাঠান ও শিখ শাসকদের এটি একটি প্রমোদকানন হয়ে ওঠে। মহারাজা রঞ্জিত সিং-এর সময়ে বাগিচার মার্বেল পাথরের মহলটি ইউরোপীয় অভ্যাগতদের অতিথিশালা হিসেবে ব্যবহৃত হত। মহারাজা হরি সিং-এর শাসনকালে এই বাগিচায় বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা হয়। এইভাবে বহু বছর ধরে নানা শাসকের রাজত্বকালে এই বাগিচার সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন হয়েছে, বিভিন্ন নামও রাখা হয়েছে। কিন্তু ‘শালিমার বাগ’ নামটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছে এবং আজও এই নামই রয়ে গেছে।

দূর থেকে তাকিয়ে দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায়, সম্পূর্ণ বাগিচাটির তিনটি সোপান। ৩১ একর জমির উপর নির্মিত এই বাগানের মূল কাঠামো ৫৮৭ মিটার লম্বা এবং ২৫১ মিটার চওড়া। প্রত্যেকটি সোপান বা ধাপের নির্মাণশৈলী ভিন্ন। প্রত্যেক সোপানে আছে ঝর্ণা, চিনার গাছ ও নানা ফল-ফুলের গাছ শোভিত উদ্যান বীথী। পারস্য উদ্যান শৈলী নকশা অনুসারে একটি সমতল ভূমিকে কেন্দ্র করে চারদিকে চারটি হাতায় বাগিচা প্রসারিত। প্রাকৃতিক ঝর্ণার জল একটি প্রধান কুণ্ড, শাহ্ নাহার-এ এসে পড়ছে এবং পাহাড়ি ভূমির উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে কৌশলে সেই জল সরবরাহ করা হয়েছে বাগিচার সর্বোচ্চ সোপান থেকে সর্বনিম্ন সোপান পর্যন্ত। এক মাইল দীর্ঘ একটি নালার মাধ্যমে এই বাগিচা ডাল লেকের সঙ্গে সংযুক্ত।

বাগানের প্রথম সোপান সর্বসাধারণের জন্য, যার শেষপ্রান্তে প্রবেশদ্বারের ঠিক উপরে রয়েছে একটি বিরাট কক্ষ, বা বড়াদারি ‘দিওয়ান ই আম’, যেখানে কাশ্মীরে থাকাকালীন প্রতিদিন সম্রাটের দরবার বসত। এখানে ঝর্নার সামনে একটি কালো পাথরের সিংহাসন রয়েছে। দ্বিতীয় সোপানের দুটি ধাপ, সম্রাটের অন্তরঙ্গদের জন্য ‘দিওয়ান ই খাস’ ও এর পরে জেনানা বাগ ও রাজকীয় হামাম বা স্নানঘর। জেনানা বাগ-এর প্রবেশদ্বারে রয়েছে কাশ্মীর স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত পাথরের মেঝে যুক্ত দুটি প্রহরী কক্ষ। জেনানা বাগ-এ শাহজাহান কালো মার্বেল পাথরের একটি ছোট ‘বড়াদারি’ নির্মাণ করিয়েছিলেন, যাকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে একটি কৃত্রিম জলাশয়, উঁচু সোপান থেকে ঝর্নার জল এসে ঐ জলাশয়ে পড়ছে, তার মাঝখানে, সম্ভবত মেয়েদের ভেজা পোশাক পরিবর্তনের জন্য, রয়েছে নিচু ছাদ ও কুলুঙ্গিযুক্ত ঘর, ‘চিনিখানা’, চিনিখানার উপর দুপাশ থেকে জলপ্রপাতের জল আছড়ে পড়ছে, অপূর্ব শোভা সৃষ্টি করেছে। শালিমার বাগে সব মিলিয়ে প্রায় ৪০০ টিরও বেশি ঝর্না আছে। জেনানা হামাম থেকে দুটি জলের নালা পিছনে আরেকটি কালো পাথরের ছোটা বড়াদারির দিকে বইছে। তৃতীয় সোপানের শেষপ্রান্তের উপরে একটি অষ্টভূজাকার মণ্ডপ রয়েছে, এটাই বাগানের সীমান্ত প্রাচীর। সমগ্র বাগানের পটভূমিকায় তুষারশৃঙ্গ হিমালয়ের মৌনমহান প্রহরা। ঘুরে ঘুরে সম্পূর্ণ বাগান দেখতে প্রায় দু’ঘণ্টা কেটে গেল। শালিমার বাগের উপরের সোপানে কালো পাথরের মণ্ডপের উপরে ফার্সি ভাষার কবি আমির খসরুর লেখা বিখ্যাত সেই শিলালিপি রয়েছে—“আগর ফিরদৌস বার রায়-ই জমিন আস্ত, হামিন আস্ত-ও হামিন আস্ত-ও হামিন আস্ত-ও।” এর অর্থ, “যদি পৃথিবীর বুকে কোথাও স্বর্গ থাকে, তা এখানে, এখানে, এখানেই।” তুষারাবৃত পীরপাঞ্জাল পর্বতশ্রেণীর মধ্যে দিয়ে দুর্গম পাহাড়ি পথ ধরে হাতির পিঠে চড়ে পত্নী নূরজাহানকে সঙ্গে নিয়ে এখানে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনে আসতেন সম্রাট জাহাঙ্গীর, দুয়েক বার নয়, ইতিহাস বলছে, মোট ১৩ বার তারা এখানে এসে দীর্ঘ অবকাশ যাপন করেছেন। লোকে বলে যে, জাহাঙ্গীর যখন মৃত্যুশয্যায়, তাঁর কোথায় থাকতে ইচ্ছে করছে, জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন: “কাশ্মীর ছাড়া আর কোথায়? অন্য সব স্থান আমার কাছে মূল্যহীন।”

চিত্র-৪> জেনানা হামাম, চিনিখানা, শালিমার বাগ, শ্রীনগর; ফটোস্বত্ব-লেখক

স্কুলবেলায় ইতিহাসের পৃষ্ঠায় পড়া কাহিনীগুলো আমার কাছে জীবন্ত হয়ে উঠছিল। ইতিমধ্যে সূর্যাস্তের রঙ আকাশ রাঙাতে আরম্ভ করেছে। সাদা সালোয়ার কামিজ ও কালো ওড়নায় একদল ‘কাশ্মীর কি কলি’ বালিকা ও কিশোরি কন্যা সম্ভবত কোন স্কুল থেকে এসেছে, চিনিখানার সামনের পুলে জল ছিটিয়ে তুমুল হৈ-হল্লা করে তারা স্নান করছে। তাদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের কলকাকলী কূলায় ফেরা পাখির কূজনকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে। ভরপুর মনে মোবাইল গ্যালারি ভরা ছবি নিয়ে বেরিয়ে এলাম ভালবাসার এই আনন্দকানন থেকে।

শওকত বলল, আজ আর অন্য কোথাও যাওয়ার সময় নেই, তাই গুরুদ্বারা দর্শনে না গিয়ে আমরা সোজা চলে এলাম ডাল লেকের ধারে, উদ্দেশ্য ‘শিকারা ভ্রমণ’।

দিনের শেষে নৌকাবিহার

চিত্র-৫>সূর্যাস্তের আবীরে রাঙানো ডাল লেক, শ্রীনগরের মুকুটমণি; ফটোস্বত্ব-লেখক

শালিমার বাগ থেকে বেরিয়ে আমরা চলে এলাম ডাল লেকের ধারে, যেখানে সারি সারি শিকারা পর্যটকদের জন্য অপেক্ষমাণ। কাশ্মীরের মুকুট হল শ্রীনগর, আর ডাল লেক তার মুকুটমণি। শিকারা হল একরকম ছোট নৌকা, বৈঠা নিয়ে একজন দাঁড় বেয়ে যায় ঝিলের জলে, আর সুসজ্জিত নৌকার ভিতরে আরাম করে আধশোয়া হয়ে তীরের ঢেউ খেলানো পাহাড় আর ফুল বাগিচা দ্যাখে পর্যটক। নৌকার ভিতরে কাঠের বেঞ্চের উপর গদি পেতে তাতে নরম কম্বল বিছিয়ে বসার আরামদায়ক ব্যবস্থা, পাটাতন ঢেকে রাখা কাশ্মীরী কার্পেটে। শিকারার কাছে পৌঁছতেই আমাদের ঘিরে ধরল মাঝিমাল্লাদের দল। দরাদরির পর ৮০০ টাকায় দেড় ঘণ্টা ভ্রমণের রফা হল। আমরা চারজন ছিলাম, অতএব মাথাপিছু ২০০ টাকা করে পড়ল। রহমান চাচার বোট, চাচা বলল, “আমার ভাতিজা যাবে।” কিন্তু জিনস-প্যান্ট পরিহিত আধুনিক হেয়ার স্টাইলের ভাতিজাকে দেখে আমার কেমন মনে হল, ও পুরনো দিনের গল্প জানে না। আমি বায়না ধরলাম, “চাচা আপ হি চলিয়ে। হামকো কাহানি শুননা হ্যায়, আপকা ভাতিজা তো বিলকুল হিরো হ্যায়। উসকো কেয়া পাতা হোগা পুরানি বাঁতে?” মাল্লাদের মধ্যে হাসির হররা উঠল আমার কথায়। আমার অনুরোধে চাচা রাজী হল, দাঁড় বাইতে বাইতে বলে চলল, ইয়ে হ্যায় “মিনা বাজার” (সবজি ও অন্যান্য মণিহারী দ্রব্যের ভাসমান বাজার), ও দেখো “চার চিনার” (প্রাচীন চারটি চিনার গাছে ঘেরা একটি দ্বীপ), ইয়ে “ফ্লোটিং আইল্যান্ড” (খানিকটা জায়গায় ভাসমান জলজ পানা), একটা জায়গায় কয়েকটা পদ্ম ফুটে আছে, সেদিকে দেখিয়ে বলল, “লোটাস আইল্যান্ড”, আর সূর্যাস্তের আভায় গলানো সোনার মত আন্দোলিত ঝিলের জল দেখিয়ে বলল, ইয়ে “গোল্ডেন লেক।” দরদস্তুর করে বোটে চাপার আগে মাঝিরা বলে, আটটা ‘স্পট’ দেখাবে, যার মধ্যে চারটি দর্শনীয় বস্তু আছে ২২ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত ডাল লেকের মধ্যেই। এগুলো হল সেসবই, আসলে সবটাই ট্যুরিস্টদের বোকা বানানো ব্যাপার। এছাড়াও রহমান চাচা হাত তুলে লেকের তীরে শালিমার বাগ, নিশাত বাগ, তাজ হোটেল আর হজরত বাল মসজিদ দেখিয়ে দিল। কিন্তু সত্যিকারের স্মরণীয় হয়ে থাকল মৃদুমন্দ পবনে শান্ত ঝিলের বুকে ভেসে বেড়ানো। চারদিকে ঘিরে থাকা ঘন সবুজ জাবারওয়ান পর্বতমালার গম্ভীর প্রাচীর, অস্তগামী দিনমণির স্বর্ণাভ কিরণে ঝিলের জল গলানো সোনার মত ঝলমল করে, দূরে তীর ঘেঁষে সারি সারি অসংখ্য ভাসমান হাউজবোট, ইতস্তত ভাসমান নৌকায় ফেরিওয়ালার হাঁকডাক—“কাহওয়া পীলো,” “আখরোট লে লো,” একটা স্বপ্নের ঘোরের মত সময়টা কেটে যায়। জল ছেড়ে ডাঙায় উঠে গলা ভেজাবার জন্য কিছু ঠাণ্ডা কিনে নিয়ে আবার গাড়িতে উঠে পড়লাম, হাউজবোটে ফিরতে হবে।

কাশ্মীরের ঐতিহ্য—হাউজবোট: জলের উপর ভাসা পানকৌড়ির বাসা


আমার স্বামীর শ্রীনগরের বন্ধুর মধ্যস্থতায় আমাদের হাউজবোটে থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। দু’দিন মিটিং আর তিনদিন টই টই। ভ্রমণ-মরশুমে ডাল-লেকের হাউসবোটগুলো উড়ে আসা পরিযায়ী পাখিদের মত পর্যটকের ভীড়ে একেবারে ঠাসা। তাই সামাল দিতে ডাল লেকের শাখা নিগিন (বা নাগিন?) লেকেও প্রচুর হাউসবোটে থাকার ব্যবস্থা। আমাদের হাউজবোটও নিগিন লেকের উপরে ভাসমান। হাউজবোটে এই প্রথম থাকা। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা! উনিশ শতকে ইউরোপিয়ানরা কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানে থাকার জন্য জমি কিনতে গিয়ে বাধা পেল। কারণ তখন কাশ্মীরে বহিরাগতদের জন্য জমি কেনা নিষিদ্ধ ছিল।

এই বাধা ইউরোপীয়রা জয় করেছিল জলের উপর ভাসমান এই হাউজবোটের উদ্ভাবনী ভাবনার মাধ্যমে। সেই থেকে হাউজবোটে থাকা কাশ্মীরে আসা পর্যটকদের কাছে একটা ঐতিহ্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে শ্রীনগরের ডাল লেকে অবস্থিত হাউজবোটগুলো অধিকাংশই ১৯৭০-৮০ সালের এবং জীর্ণদশা প্রাপ্ত। এদের আশু মেরামতি প্রয়োজন। ডাল ও নিগিন উভয় লেক মিলিয়ে প্রায় ১০০০ হাউজবোট। করোনা মহামারীর কারণে পর্যটন ব্যবসা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেক হাউজবোটের মালিকরা তাদের বোট সরকারকে বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন (প্রায় ১৩৪ টি), তবে এ বছর থেকে আবার পর্যটন ব্যাবসা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

চিত্র-৬>নিগিন লেক-এর উপর ভাসমান হাউজবোট, শ্রীনগর; ফটোস্বত্ব-লেখক

প্রতিটি হাউজবোটের ভিতরে বসবাসের আধুনিক ব্যবস্থাযুক্ত প্রায় চার-পাঁচটা ঘর রয়েছে। ঘরগুলোর আবার স্থানীয় ভাষায় ডাকনামও আছে। লবি হল মিথিব, রান্নাঘর বুশকান, বড় হলঘর ডোরাক। জলের উপর বাঁশের সাঁকো বেয়ে হাউজবোটে উঠবার ব্যবস্থা। শুয়ে বসে জলের শোভা দেখবার জন্য বারান্দা, বারান্দা পেরিয়ে বৈঠকখানার মত বড় হল, তারপর ডাইনিং, একপাশে রান্নাঘর, সবশেষে ভিতরের দিকে শোবার ঘর ও ঘর সংলগ্ন বাথরুম। আগাগোড়া কাঠের পাটাতন ঢেকে দিয়ে কার্পেট পাতা। বোটের ফলস সিলিং-এ ও কাঠের পার্টিশন দেওয়ালে অপূর্ব কারুকার্য। একসঙ্গে কয়েকজন চলাফেরা করলে বোট যেন দুলে ওঠে। মনে হয় এই বুঝি পানকৌড়ির মত জলবাসা ভাসতে ভাসতে পাড়ি দেবে অচিন পুরে! তা আর হয়নি। পানকৌড়ির বাসায় একটা দিন-রাত থাকার খরচ ৩৫০০ টাকা, সকালের নাস্তা আর রাতের ডিনার এই ভাড়ার সঙ্গে ধরে নেয়।

দিনের শেষে শওকত আমাদের গাড়ি থাকে নামানোর আগে ওর বৌ ফোন করল, আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেয়া শওকত ভাইয়া, হোম মিনিস্টারনে ফোন কিয়া?” ও হাসল, “আরে, প্রাইম মিনিস্টার কা ফোন!” বৌ জিজ্ঞেস করছে, মিয়াঁ কখন ফিরবে। ও ফোনটা ভিডিও মোড-এ দিয়ে আমার সঙ্গে বৌ-এর আলাপ করালো। সেও বলতে লাগল, “ম্যাডামজীকো হামারা ঘর লে আও।” পরে শুনলাম, ট্যুরিস্ট মরশুমে অনেকেই হোটেল বা হাউজবোটে জায়গা না পেয়ে স্থানীয় লোকের ঘরে থাকে। বেড়াতে এসে যার গাড়িতে ঘোরা হয়, সেই ড্রাইভারের ঘরেই পরেরবার এসে ওঠে অনেকে। এখানে এরকম চল আছে। ড্রাইভারি সূত্রেই আরও ব্যবসা হয়, সেকথা পরে বুঝেছি। আপাতত আমি কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ, শওকতের আন্তরিকতায় আপ্লুত ও সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত একটানা ঘোরাঘুরির ধকলে ক্লান্তিতে চুরচুর। অতএব হাউজবোটে প্রত্যাবর্তন। পোশাক বদলে রাতের খাবার খেয়ে নিগিন লেকের উপর ভাসমান বোটের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। শান্ত ঝিলের জলে দূরের পাহাড়ে জ্বলে থাকা আলোর রোশনাইয়ের ঝিলিমিলি, চারদিক নিঝুম, আকাশে ঘোলাটে চাঁদের মায়াবী জ্যোৎস্না। নিকটস্থ জলজ ঝোপঝাড় থেকে ক্বচিৎ ভেসে আসছে জলচর পাখির অস্ফুট ‘কুক’ ‘কুক’ ডাক। সভ্যতা থেকে অনেক দূরে আমি হারিয়ে গেছি। আমি কি মেঘদূতের সেই বিরহী যক্ষের প্রতীক্ষায় থাকা বিরহিনী প্রিয়া?

চিত্র-৭>নিগিন লেক-এর ট্রাউট-ফিশ সন্ধানী; ফটোস্বত্ব-লেখক

জুন মাসের শেষে এসেছি। গুগল সার্চ করে তাপমাত্রার খবর নিয়ে জেনেছি দিনের বেলা ২৫-২৮ ডিগ্রির কাছাকাছি আর রাত্রে ১৫-১৮ ডিগ্রী হতে পারে। অতএব গরম জামাকাপড় নিয়ে যাওয়ার দরকার তেমন নেই। অথচ আমার স্বামী বললেন, “পাহাড়ি ওয়েদার, কোন ভরসা নেই। রাত্রে ১৫ বলছে, যদি ওটা ১০-এ নামে, কী অবস্থা হবে বুঝতে পারছ তো? অতএব গরম কাপড় নিতেই হবে।” ও জন্মের শীতকাতুরে। তবুও ওর কথা মেনেই ব্যাগ বোঝাই হল। কিন্তু আসার পর থেকে রীতিমত ঘর্মাক্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছি এবং হাইজবোটে ফ্যান ছাড়া থাকা যাচ্ছে না। যাইহোক, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে। আগামীকাল সকালে আমরা ভাড়া করা মিনিবাসে যাব পেহেলগাঁও।

দিন ২: পেহেলগাঁও—এই বনপথে যেতে যেতে শুধু সবুজ সবুজ উপহার

চিত্র-৮>আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে শ্রীনগর থেকে পেহেলগাঁও; ফটোস্বত্ব-লেখক

শ্রীনগর থেকে রওনা হলাম পেহেলগাঁও-এর উদ্দেশ্যে। কিছুদূর যেতে যেতেই টের পেলাম পথে প্রচুর সেনা টহল দিচ্ছে। অমরনাথ যাত্রা শুরু হবে আগামীকাল থেকে। পেহেলগাঁও হল তীর্থযাত্রীদের প্রথম শিবির, পথের দুধারে শুকনো খাবারের বস্তা ডাই করে রাখা, নানা জায়গায় বাস ঘুরিয়ে দেওয়া হল। ফলে নির্ধারিত সময়ে পৌঁছানো যাবে না বুঝলাম। দেরী হলেও মনে কোন টেনশন নেই, কারণ জরুরি কাজকর্ম শিকেয় তুলে বেড়াতেই তো এসেছি। তাই বাসে বসে বসে নিসর্গ শোভা দেখতে দেখতে চলেছি।

চিত্র-৯>পথে সর্বত্র সেনা-প্রহরা; ফটোস্বত্ব-লেখক
চিত্র-১০>মসজিদের দেওয়ালে অমরনাথ যাত্রীদের স্বাগত-বার্তা; ফটোস্বত্ব-লেখক
চিত্র-১১>অমরনাথ তীর্থযাত্রা আরম্ভে পথে যানজট; ফটোস্বত্ব-লেখক
চিত্র-১২>পাহাড়ের কোলে বাজার বসেছে, শ্রীনগর থেকে পেহেলগাও যাত্রাপথে; ফটোস্বত্ব-লেখক
কোলের মধ্যে জোছনা নিয়া/আলোর বাটি পাইতা রই


চলতে চলতে সমানে ছবি তুলছি। কাশ্মীরের বাড়িগুলো দেখতে খুব সুন্দর। প্রত্যেক বাড়ির সামনে খানিকটা করে জমি। আমাদের উঠোনে যেমন তুলসীর চারা আর পেয়ারা গাছ, এদের আপেল আর আখরোটের গাছ। থলো থলো আখরোট ঝুলে আছে, সবুজ-আধা হলুদ, কিম্বা লালচে রঙ ধরতে আরম্ভ করা আপেল ফলে আছে। আর থোকা থোকা রডোডেনড্রন, গোলাপ ফুলের বিপুল সমারোহ। ডাল লেকের কাছে দু-একটি হোটেল ছাড়া কাশ্মীরে অ্যাপার্টমেন্ট জাতীয় কোন বিল্ডিং চোখে পড়েনি। সবারই নিজস্ব বাড়ি এবং লাগোয়া বাগান। শওকতের মুখে শুনেছিলাম, জমি মাপার একককে ওখানে ‘কানাল’ বলা হয়, আট কানাল-এ হয় এক ‘ঘুমান’ অর্থাৎ এক একর। অতএব এক কানাল প্রায় আমাদের হিসাবে ৫৫০০ বর্গফুট এলাকা। ২০ মারলায় হয় এক কানাল। অধিকাংশ বাড়ি ২০/২০ মারলা, স্কোয়ার প্ল্যান। কেমন, সেটা বলছি।

শ্রীনগর, পেহেলগাঁও আর গুলমার্গের সর্বত্র, যত ঘরবাড়ি দেখেছি, দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া সবই ৩০০ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। কাঠের বাড়ি, বৃষ্টি আর তুষারপাতের জন্য ঢালু ছাদ, জানালার ফ্রেমে, বারান্দায় চোখ জুড়ানো পিঞ্জেরাকারি কারুকাজ ‘ঝুমকা’-র মতো রূপ দিয়েছে। ঘর থেকে উঁকি মেরে মুখ বাড়িয়ে আছে চাঁদ দেখবার ঝুলবারান্দা। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের একটা গান শুনেছিলাম, “কিছুই যদি নাই থাকে আর/কিছুই যদি নাই বাঁধে/চাইতে চাইতে অন্ধ দুচোখ/মুখ রাখিবে কার কাঁধে/কোলের মধ্যে জোছনা নিয়া/আলোর বাটি পাইতা রই/স্বপ্নে তুই আবার ঘুমাস/আমি শুধু জাইগা রই।” প্রাচীন পারস্য শৈলীর রূপকথার গল্পের মত ঐ বাড়িগুলো দেখতে দেখতে মনে হল, কোলের বাটিতে জ্যোৎস্নার শুভ্র কিরণ নিয়ে আমিও বুকভরা বিরহ নিয়ে জন্মান্তরে কত রাত জেগেছি মধুর প্রতীক্ষায় অমন এক ঝুল বারান্দায়!

চিত্র-১৩>পারস্য স্থাপত্য শৈলীর বাড়ি; ফটোস্বত্ব-লেখক


বাড়িগুলো বেশিরভাগই দু’তলা। তবে একতলা বাড়িও কিছু কিছু দেখেছি, পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে একলা দাঁড়িয়ে আছে, পায়ের কাছ দিয়ে বইছে লিডার নদী, স্বাধীনচেতা এক একলা মেয়ে যেন। এখানে বেশির ভাগ পুরনো বাড়ি ‘দাজ্জি দীবার’। কাঠের ফ্রেমওয়ালা পাথরের দেওয়াল, ফাঁকফোঁকরগুলো বোজানো হয় পাথরকুচির সঙ্গে কাদামাটি আর গোবরের মিশ্রণে। আরও ছোটখাট ফাঁক থেকে গেলে গুঁজে দেওয়া হয় ছোট পাথরের টুকরো। ‘দাজ্জি দীবার’ টেকনোলজি দারুণ মজবুত আর ভূমিকম্প-সহনশীল। যেন তেন বাড়িতেও তিন থেকে পাঁচটি শোবার ঘর, তিন-চার ভাই তাদের স্ত্রী ছেলেমেয়ে ও বাবা-মা নিয়ে একত্রে থাকে। একটি রান্নাঘর, মাঝে একটি খোলা পরিসর, উঠোনের মত, সেখানে বাচ্চারা খেলে। অনুষ্ঠানের পাকশালাও হয় ঐ উঠোনে। সিঁড়ির রেলিং-এ, ঘরের সিলিং-এ, দেওয়ালের কোণে সর্বত্র আখরোট আর দেবদারু কাঠের অপরূপ ‘খাটামবান্দ’ কাজ; ফলস সিলিং, বিনুনীর মত পাকানো কাঠ ও বাঁশের জ্যামিতিক কারুকাজে পার্শি আর্টের প্রতিফলন।

চিত্র-১৪>হাউজবোটের কাঠের নকশা; ফটোস্বত্ব-লেখক

বেশ ঘুরে ঘুরে অনেক বেলায় পৌঁছানো গেল হোটেল-ক্রাউন ভিউ, মালপত্র হোটেলের ঘরে রেখে বেরোলাম দুপুরের ভোজনের সন্ধানে। প্যারাডাইস হোটেলে আমিশ-নিরামিশ গোষ্ঠী ভাগাভাগি করে খাওয়া হল রোগন জোস, খামিরি রোটি, ইয়াখনি পোলাও, দই, সালাড, সাগ-ডাল, আলু-ভিন্ডি, মটর-পনীর।

চিত্র-১৫>পেহেলগাও-এ পেহেলা লাঞ্চ; ফটোস্বত্ব-লেখক
বেতাব ভ্যালি


ভোজন পর্ব শেষ হলে হোটেলে ফিরে না গিয়ে বাসেই আশপাশের জায়গাগুলো ঘুরে দেখতে বের হলাম। আমাদের সঙ্গে এসেছে স্থানীয় গাইড মঞ্জুর খান। ও ‘বেতাব ভ্যালি’ দেখাতে নিয়ে চলল। পথে পড়ল লিডার অ্যামিউজমেন্ট পার্ক। খরস্রোতা লিডার নদীর বয়ে চলার পথে ধাপে ধাপে নানা উচ্চতায় বড় বড় পাথরের চাতাল। চারদিকে পাহাড়, প্রাচীন বিশাল দেবদারু আর পাইনের বন। এই মনোরম জায়গায় গাড়ি থামিয়ে ট্যুরিস্টরা খানিক বসে, ছবি তোলে।

পেহেলগাঁও থেকে ১৫ কিমি দূরে অনন্তনাগ জেলায় বেতাব ভ্যালি। পঞ্চদশ শতাব্দিতে যখন মুঘল সম্রাটরা এই উপত্যকার আশপাশের এলাকা শাসন করতেন, তখন এর নাম ছিল হাগুন বা হাগান উপত্যকা। পরে ব্লকবাস্টার বলিউড সিনেমা ‘বেতাব’-এর শ্যুটিং হয় এখানে, তারপর থেকেই এই উপত্যকা বেতাব ভ্যালি নামে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে। হিমালয়ের পীরপাঞ্জাল ও জাঁস্কার পর্বতমালার মাঝে এই অপরূপ পাহাড়ি উপত্যকা। ‘বেতাব’ মানে অপেক্ষায় অধীর হয়ে ওঠা, এই উপত্যকার চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যও ভ্রমণার্থীর মন আনন্দে অধীর করে তুলবে। পাইন-দেবদারুর ঘন প্রাচীরে ঘেরা ভেলভেটের মত মোলায়েম সবুজ ঘাসের গালিচা, তিনদিকে বরফে ঢাকা সবুজ পাহাড় আর পুরো উপত্যকাকে দুভাগে চিরে প্রবল বেগে বয়ে চলেছে লিডার নদী। পেহেলগাঁও আর চন্দনওয়ারির মাঝে শেষনাগ হ্রদ, যার ঠিক মুখে এই উপত্যকা। অমরনাথ তীর্থযাত্রীদের যাত্রা পথেই পড়ে এই হ্রদ ও ভ্যালি। ছবির চেয়েও সুন্দর এই উপত্যকার মধ্যে লিডার নদীর এক পাশে ততোধিক সুন্দর বাতোতি পার্ক, পার্কের ভিতরে রয়েছে আইসক্রিম ও অন্যান্য রিফ্রেশমেন্ট-এর ব্যবস্থা। প্রতি দশ পা এগোলেই একজন ফটোগ্রাফার দাঁড়িয়ে রয়েছে, কাশ্মীরী পোশাকে সাজিয়ে (লোক বুঝে ১০০-২৫০ টাকার বিনিময়ে) ছবি তুলে দেবে, পর্যটকরা কাশ্মীর ভ্রমণের স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ যা ঘরে সাজিয়ে রাখে। নরম উলের গোলার মত ভেড়া কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেষপালক, সেও চায়, তার ভেড়া কোলে নিয়ে আপনি ছবি তুলুন, বিনিময়ে গরীব মানুষটিকে কিছু অর্থ দিন।

চিত্র-১৬>পটে আঁকা ছবির মত সুন্দর বেতাব ভ্যালি; ফটোস্বত্ব-লেখক

ফেরার আগে আমার স্বামী বললেন, “একটু নদীর জল ছুঁয়ে আসি!” আমার ভয় হল। বললাম, “দেখো বাপু, সন্ধ্যা হয়েছে, পাহাড়ি নদী খরস্রোতা। পা পিছলে গেলে ভয়াবহ ব্যাপার। তায় তোমার জুতো পায়ে…,” ও আমাকে আশ্বস্ত করল। আমি জল ফুরিয়ে যাওয়া ছোট্ট বোতলটা ওর হাতে দিয়ে বললাম, নদীর জল ভরে এনো।” একটু দূরে ঘাসের উপর বসলাম। অনেক মানুষ এসেছে আজ। অমরনাথ যাত্রার সময়ে এই জুলাই আগস্ট মাসে এখানে ভীড় হয়। কিন্তু পাহাড়ের কোলে এমন বিস্তার যে ভীড় হলেও সেটা গায়ে গা ঠেকে যাওয়া কখনোই হয় না। ও ফিরে আসছে। জল ভরতে পারেনি। একটু উঁচু পাথরের উপর থেকে ঝুঁকে জল ছুঁয়েছে কেবল। আমার মায়ের বাতিক ছিল কোথাও নদী বা কুণ্ড দেখলেই ডুব দেওয়ার। মায়ের সঙ্গে যত তীর্থে গিয়েছি, আমি তল্পিতল্পা নিয়ে তীরে বসে থাকতাম, মা ডুব দিয়ে উঠে আমার জন্য দুই হাতের অঞ্জলীতে জল এনে মাথায় ছিটিয়ে দিতেন। আমি একটু আবেগপ্রবণ হয়ে ওর ভেজা হাত ধরলাম। পাশ থেকে আমাদের গ্রুপের এক সঙ্গিনী বলে উঠল, “এবার আমরা বেশরম ভ্যালি যাব।” এরপর আমাদের বৈশরন ভ্যালি যাওয়ার কথা ছিল। মহিলার কথায় ও চোখের ইঙ্গিতে বিদ্রূপটা গোপন থাকল না। আমি আরেকটু ‘বেশরম’ হয়ে ২৯ বছরের বিবাহিত স্বামীর হাত দুটো আমার চোখে স্পর্শ করালাম, মনে মনে বললাম, “ওগো পবিত্র নদী, এমন করো যেন, ‘নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো, যেখানে পড়বে সেথা দেখবে আলো’!” ঐ মহিলা প্রথম দিন থেকেই কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমাকে সহ্য করতে পারছিল না। একান্ত এক মুহূর্তে সেটা জানার চেষ্টা করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম ওঁর বিবাহিত জীবনের দীর্ঘ বঞ্চনা আর যন্ত্রণার এক ইতিহাস। তাই হয়তো আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা ও বন্ধুত্বের ব্যাপারটি মনের ক্ষতস্থানে জ্বালা ধরিয়েছে! কাশ্মীরের উঁচুনিচু জমির পরতে পরতেও জমে আছে এমন অনেক ক্ষোভ আর অভিমান। সময়াভাবে বৈশরন ভ্যালি যাওয়া হল না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এবার হোটেলে ফিরতে হবে।

চিত্র-১৭>বেতাব ভ্যালির বুক চিরে প্রবাহিত লিডার নদী; ফটোস্বত্ব-লেখক
দিন ৩: গুরুদ্বারা মট্টন সাহিব, আচ্ছাবল, কোকারনাগ, ভেরিনাগ


আগের দিন হোটেলে ফিরতে রাত হয়েছিল। রাস্তাজুড়ে বিরাট যানজট। প্রত্যেকটা গাড়িকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল সেনাবাহিনীর জওয়ানরা। হোটেলের নিজস্ব রেস্তোরাঁয় খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। সকালে ফের শ্রীনগর ফেরা। সকালে ভারী জলখাবার খেয়ে রওনা হলাম। পথে পড়ল মাট্টান মন্দির। ভাবলাম, বোধহয় স্থানীয় উচ্চারণে মার্তণ্ডকে মট্টন বলছে। কিন্তু আসল মার্তণ্ড মন্দির এখন অনেকটাই ধ্বংসস্তুপে পরিণত। এই মন্দিরটা অপেক্ষাকৃত নতুন। পরে জানলাম সম্পূর্ণ নাম- ‘গুরুদ্বারা মট্টন সাহিব’।

চিত্র-১৮>ব্রহ্মদাস-এর চৈতন্যলাভের সাক্ষী প্রাচীন চিনার বৃক্ষ; ফটোস্বত্ব-লেখক

পঞ্চদশ শতাব্দির মধ্যভাগে চীন, তিব্বত ও মানসরোবর ভ্রমণকালে শিখ ধর্মগুরু গুরু নানক এসেছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার এই মট্টন গ্রামে ও ১৩ দিন এখানে থেকে ধর্মপ্রচার করেছিলেন। প্রাচীন গুরুদ্বারাটি ভগ্নদশাপ্রাপ্ত হলে ১৯ শতকে নতুন গুরুদ্বারা তৈরি করা হয়, এখন যেটা আমরা দেখছি। এই গুরুদ্বারার একটি প্রধান আকর্ষণ প্রাচীন বিশাল একটি চিনার গাছ। চিনার গাছ কাশ্মীরে আশ্চর্য বস্তু নয়, তবে এই গাছটি দেশ বিদেশ থেকে এখনও লোকে দেখতে আসে। এর নেপথ্যে একটা কাহিনী আছে। শোনা যায়, এই গ্রামে ব্রহ্ম দাস নামে একজন বিখ্যাত পণ্ডিত বাস করতেন। তিনি অসংখ্য পুঁথি পাঠ করেছেন। যেখানেই যেতেন, সঙ্গে করে মোটা মোটা পুঁথি নিয়ে যেতেন। গুরু নানকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলে তাঁকে দেখেই নানক বলে ওঠেন, “যতই পুঁথি পাঠ কর, জগতের সমস্ত পুঁথি পড়ে ফেললেও ঈশ্বর উপলব্ধি না হলে জীবন অর্থহীন।” পণ্ডিত তাঁর জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে উপস্থিত হয়েছিলেন, সদগুরুর একটি কথায়ই তাঁর চৈতন্য হল। তিনি নানকের পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। যতদিন নানক ছিলেন ঐ গ্রামে, তিনি ছায়ার মত তাঁর সান্নিধ্যে বাস করলেন। এই চিনার বৃক্ষটি ব্রহ্ম দাসের চৈতন্য প্রাপ্তির স্থানেই জন্মেছে বলে লোকের বিশ্বাস। এই মন্দির প্রাঙ্গনের ভিতরে আছে একটি সূর্য মন্দির, বিষ্ণুমন্দির ও ভবানী মন্দির সহ একটি গুরুদ্বারা। একটি বড় পুষ্করিণীও আছে, পাহাড়ি ঝর্নার জল একটি নালার মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে এই পুষ্করিণীতে জমা হয়। পুকুরে প্রচুর মাছ। দর্শনার্থীরা ছোলা কিনে মাছকে খাওয়ায়। আমিও খাওয়ালাম। ছোলা জলে ছুঁড়ে দিলেই দলে দলে মাছ এসে খাচ্ছে, দেখে অনাবিল আনন্দ পেলাম। স্বচ্ছ নীল জলের পুষ্করিণীর মাঝখানে ছোট খোলা মন্দিরে আছে একটি শিবলিঙ্গ। জুতো খুলে মাথায় রুমাল জড়িয়ে গুরুদ্বারায় প্রবেশ করে গুরু নানকের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম। একজন সুজির হালুয়া প্রসাদ দিল। জল খেতে বাইরে এসেছি, গুরুদ্বারার সেবক ফ্লাস্ক থেকে গরম চা ঢেলে দিলেন। এখানে পরিবেশ ভারি মনোরম। বিশাল ও প্রাচীন অনেক চিনার গাছ আছে এখানে। কাশ্মীরে চিনার গাছ কাটা নিষিদ্ধ। বাইরে ফলের দোকান থেকে পথে খাওয়ার জন্য কিনে নেওয়া হল ১০০ টাকা কেজি দরে লাল টুকটুকে তাজা পাম-ফল।

চিত্র-১৯>ছোলা কিনে মাছেদের খাওয়ানোর আনন্দ; ফটোস্বত্ব-লেখক
চিত্র-২০>মনোরম পেহেলগাঁও উপত্যকায় লিডার নদীর কিনারে
আচ্ছাবল


সৌন্দর্যপ্রেমী মুঘলদের বাগানবিলাসের আরেকটি উদাহরণ আচ্ছাবল। শ্রীনগর থেকে ৬০ কিমি দূরে অবস্থিত এই বাগানটি তুলনামূলকভাবে অন্যান্য বাগ-এর থেকে ছোট। প্রাচীনকালে এটি অক্ষবল নামে একটি হিন্দু তীর্থ ছিল। ১৬২০ সালে জাহাঙ্গীর-পত্নী নূর জাহান এই বাগিচা তৈরি করান এবং এখান থেকে তাঁর রাজকার্য পরিচালনা করতেন বলে তাঁর নামে এটিকে বেগমাবাদও বলা হত। পরে ১৬৩৪-৪০ সালের মধ্যে শাহজাহানের কন্যা জাহানারা বাগানটির পুনর্নির্মাণ করেন। পার্শি ঐতিহ্যবাহী ‘চাহারবাগ’ স্থাপত্য শৈলী অনুসারে বাগিচা নির্মিত হয়েছে। কোরাণে বলা হয়েছে, স্বর্গের চারটি নদী—সুরা, মধু, দুধ ও জলের। ‘চাহার’ মানে চার ও ‘বাগ’ মানে বাগিচা বা বাগান। একটি মূল ভূখণ্ড থেকে চারদিকে চারটি জলের ধারা বাগানকে চারভাগে বিভক্ত করে।

চিত্র-২১>আচ্ছাবল বাগ; ফটোস্বত্ব-লেখক

আচ্ছাবল পূর্বের তুলনায় এখন আকারে ছোট, ২৪৭ মিটার লম্বা ও ১৫৫ মিটার চওড়া। এই বাগিচারও তিনটি সোপান। এখানে ঝর্না সবচেয়ে সুন্দর। সোসানওয়ার পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে তীব্র বেগে জলপ্রপাত হয়ে ঝরে পড়ছে আচ্ছাবল বাগ-এ।

শাহজাহানের পুত্র দারা শিকো পরে এই বাগিচার ভিতরে একটি মসজিদ তৈরি করিয়ে দেন। বর্তমানে এখানে কাশ্মীরের পার্বত্য নদীর মিষ্টি জলের ট্রাউট মাছের ডিম পোনা তৈরির একটি কেন্দ্রও রয়েছে। পর্যটকদের কাছে আচ্ছাবলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল অপূর্ব বেগবতী একটি ফোয়ারা বা প্রস্রবণ। বলা হয় ভৃঙ্গী নদীর একাংশ বরাং পরগনার ওয়ানি দিবালগাঁও গ্রামের কাছে একটি বড় পাথরের খাঁজে নিখোঁজ হয়ে গেছে, আচ্ছাবলের প্রস্রবণ সেই হারিয়ে যাওয়া ভৃঙ্গী নদী।

ভেরিনাগ

চিত্র-২২>ঘন বন-পাহাড়ে ঘেরা ভেরিনাগ কুণ্ড; ফটোস্বত্ব-লেখক

দেবদারু, পাইন গাছের ঘন জঙ্গলে ঘেরা ভেরিনাগ গ্রামে পাহাড়ের উপর থেকে নেমে আসা

ভেরিনাগ ঝর্না পাহাড়ের পাদদেশে কোন বিশেষ আকার হীন একটা জলা মত তৈরি করেছিল। সৌন্দর্যপ্রেমী জাহাঙ্গীর এখানে এসে ঝর্নাটির পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে এটি সংস্কার করার চিন্তা করেন। তিনি ইরান থেকে দক্ষ কারিগর এনে এই ঝর্নার চারপাশ পাথরের অষ্টভূজাকার কুণ্ডের আকারে বাঁধিয়ে দেন, যাতে ঝর্নার জল এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে না পড়ে এই কুণ্ডের মধ্যে জমা হয়। জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের ১৫ তম বছরে তিনি এটি তৈরি করেন, সেসময় সংলগ্ন এলাকায় একটি বাগিচাও নির্মাণ করেন। জায়গাটি জাহাঙ্গিরের এতই পছন্দের ছিল যে, তিনি চেয়েছিলেন, তাঁকে যেন এখানেই সমাধিস্থ করা হয়। কিন্তু তাঁর সেই ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। কুণ্ডের দক্ষিণে ও পশ্চিমে দুটি পাথরের ফলকে পার্শি ভাষায় কুণ্ডের মহিমা ও এটি নির্মাণের তারিখ খোদিত আছে (১০২৯ হিজরি)।

আবুল ফজল রচিত ষোড়শ শতাব্দির ঐতিহাসিক দলিল আইন-ই-আকবরী-তে ভেরিনাগ অঞ্চলের নদী ‘বিহাত’-এর উৎস হিসাবে ভেরনাগ-এর উল্লেখ আছে।

মুঘল সম্রাট নূর উদ্ দিন মুহম্মদ জাহাঙ্গীর আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরী’-তে লিখেছেন—“বাবার রাজত্বকালে ওখানে দু’বার গিয়েছি। কাশ্মীর (শ্রীনগর শহর) থেকে জায়গাটা ২০ ক্রোশ দূরে। কাছেই সাধুসন্তদের তপস্যাস্থল। পাহাড়ের গায়ে পাথর কেটে তৈরি অনেকগুলো গুহা আছে। কুণ্ডের জল স্বচ্ছ ও শুদ্ধ। আমি এর গভীরতার ধারণা করতে পারিনি, কিন্তু একটা পোস্ত দানা ফেলে দিলেও কুণ্ডের তলদেশ পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়।”

কাশ্মীরী পণ্ডিত কলহন রচিত ১২ শতাব্দির গ্রন্থ ‘রাজতরঙ্গিনী’-তে ভেরিনাগ কুণ্ড নীলকুণ্ড নামে অভিহিত হয়েছে। সর্পরাজ নীল নাগ এই নীলকুণ্ডে বাস করত।

প্রবেশদ্বার থেকে সোজা হেঁটে চলে এলাম একটা আট কোণা কুণ্ডের কাছে। কুণ্ডকে ঘিরে রয়েছে পাথরের সারি সারি স্তম্ভ, যেগুলির মাঝে মাঝে ২৪ টি অর্ধ বৃত্তাকার ছাদ আছে। কুণ্ডের জল স্বচ্ছ এবং অনেক নিচের গভীর একটি প্রস্রবণ থেকে নির্গত হচ্ছে। সমগ্র এলাকাটি ৪৬০ মিটার লম্বা ও ১১০ মিটার চওড়া আয়তাকার একটি বাগান। এটাও চাহারবাগ শৈলীতে তৈরি। কুণ্ডের জল বাগের চারটি জলের নালার মূল নালাতে এসে পড়ছে, যা দৈর্ঘ ও প্রস্থে ৩০৫ মিটার ও ৩.৬৫ মিটার।

লোকগাথা অনুসারে দেবী বিতস্তা (ঝিলাম নদীর অপর নাম) এই কুণ্ড থেকে প্রকট হতে ইচ্ছা করলেন। কিন্তু তখন সেখানে শিব বাস করছিলেন। তাই দেবীকে সেখান থেকে ফিরে যেতে হল। বিতস্তা এক মাইল উত্তর-পশ্চিমে বিথাবাতুর বা বিতস্তত্র কুণ্ড থেকে প্রকট হলেন। সংস্কৃত ভাষায় ‘ভিরহ’ মানে ফিরে যাও এবং নাগ মানে প্রস্রবণ। এই স্থান থেকে বিতস্তাকে ফিরে যেতে হয়েছিল বলে এর নাম হল ভেরনাগ বা ভেরিনাগ। নীলমাতা পুরাণ অনুসারে, কাশ্মীরে প্রাচীন কালে সতীসর নামে একটি হ্রদ ছিল। এর নিচে পাতালে পার্বতী বাস করছিলেন। কুণ্ডের কাছে বিষ্ণু লাঙলের ফলা দিয়ে খনন করে সতীসরের জল তুলে ফেলে দিয়েছিলেন, শিব তখন তাঁর ত্রিশূলের আঘাতে পার্বতীকে পাতাল থেকে তুলে আনেন। ২ কিমি দূরে ঝিলাম নদীর উৎস বিতস্ত্রত। আশপাশের ঝর্নাগুলিকে একত্রে সপ্তঋষি বলা হয়। এই সপ্তঋষি সঙ্গমে বছরে একবার মেলা বসে, ভাদ্রমাসে ১৩ দিন ধরে এই মেলা চলে। লোকে পার্বণে এই পবিত্র সঙ্গমে স্নান করে। লোহার গরাদ দেওয়া কুলুঙ্গির মত ছোট ছোট পাথরের ঘরের মধ্যে রাখা বহু প্রাচীন দেবদেবীর মূর্তি। সিঁদুর লেপা ঐ প্রাচীন মূর্তিগুলোর জন্য কিনা জানি না, তবে জায়গাটার একটা পবিত্র বাতাবরণ আছে। জলের রঙ একেবারে পান্না-সবুজ। অন্যদের দেখাদেখি আমিও ঐ কুণ্ড থেকে বয়ে যাওয়া মূল নালার জল বোতলে ভরে নিলাম, ঠাণ্ডা আর বিশুদ্ধ জল গলায় ঢালতেই যেন সমস্ত শ্রান্তি দূর হয়ে গেল।

এবার বাসে উঠে বসলাম। আমাকে একটু ফাঁকা পেয়ে বাসের ড্রাইভার ফিরোজ বলল, এখান থেকে দূরে নাকি একটা পুরনো জায়গা আছে, লোকে বলে ‘দুধ-পাথরি’। সেখানে আগে জল নয়, দুধ বইত। তারপর “সব বাহার কা আদমি আনে লাগা, বুরি নজর পড় গয়া। আভি পানি বহতা হ্যায়।” ফিরোজের ভেরিনাগের জলের মত সবুজ চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, কি জানি! সবই সত্যি হয়তো! কখনও কখনও যুক্তির শাণিত অস্ত্র সরিয়ে রেখে সব কিছু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। এখানকার পরিবেশেও মনটা তেমন হয়ে গিয়েছিল।

ফেরার পথে বাসের মধ্যে কেউ প্রসঙ্গ তুলল, “এখানে তো সবাই দেখছি খুব আন্তরিক, গণ্ডগোল তো কিছুই দেখলাম না…,” তার কথা কেড়ে নিয়ে মঞ্জুর ক্ষোভে ফেটে পড়ল। বলল, সবাই ভাবে সব কাশ্মীরীই আতঙ্কবাদী। আমাদের সন্দেহের চোখে দেখে, গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে মালপত্র সার্চ করে,” ইত্যাদি। এখানকার সাধারণ মানুষ, যেমন-শিকারা বোটের মাঝিমাল্লা, হাউজবোটের রক্ষণাবেক্ষণকারীর দল, ফল-বিক্রেতা, হোটেলের কর্মচারী, প্রাইভেট ট্রান্সপোর্টের ড্রাইভার, বাজারের শাল-পশমিনা-সালোয়ার বিক্রেতা—যেকারো সঙ্গে কথা বললেই এই যন্ত্রণা, বেদনা, হাহুতাশ উপছে পড়ে। এই স্পর্শকাতর বিষয়টি ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা অন্য প্রসঙ্গ তুললাম, “এরপর কোথায় যাচ্ছি?”

কোকারনাগ


ক্লান্তিতে একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলাম। মঞ্জুর আবার আমাদের চাঙ্গা করে তুলল। ও প্রচুর কথা বলতে পারে আর এইসমস্ত জায়গা সম্বন্ধে বেশ জ্ঞানও আছে। ও বলল, কোকারনাগের কথা। কাশ্মীরের সোনালী মুকুট নামে বিখ্যাত ব্রেং (বা বরাং) উপত্যকার উপজেলা শহর কোকারনাগ একটি বোটানিকাল গার্ডেন, বিশুদ্ধ জলের ঝর্না ও রামধনু রঙা ট্রাউট মাছের জন্য বিখ্যাত। আমরা বাস থেকে নামলাম। আচ্ছাবল এবং বেতাব ভ্যালির মতই একটি অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক উদ্যান উপত্যকা কোকারনাগ। কাশ্মীরী ভাষায় কোকার মানে মোরগ। নাগ মানে ঝর্না। ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ পাহাড়ের ফাটল থেকে তীব্র বেগে বেরিয়ে আসা ঝর্নাটি অনেকগুলো শাখায় বিভক্ত হয়ে একটা মুরগীর পায়ের মত আকার নিয়েছে বলেই এই নাম। যদিও আমার চোখে তেমন কিছু ধরা পড়েনি। আইন-ই-আকবরী-তে কোকারনাগ সম্বন্ধে বলা হয়েছে এই ঝর্নার জলে খিদে, তেষ্টা দুইই মেটে এবং এর জল অজীর্ণ রোগের ওষুধ। স্থানীয় মহিলাদের হাতে তৈরি শিল্পসামগ্রী বিক্রি করার জন্য রাজ্যের প্রথম গ্রামীন বাজার কোকারনাগেই স্থাপিত হয়েছে।

এবার সোজা হাউজবোট। চতুর্থ দিন, যে উপলক্ষে আসা হল, অর্থাৎ আমার স্বামীর সেই ‘কেজো-মিটিং’, অতএব আমার বিশ্রাম। আমি তিনদিনের ভ্রমণ মানসে ঝালিয়ে নিচ্ছি। এই অবসরে কাশ্মীরী খানাপিনার কথা বলা যাক।

কাশ্মীরী খানাপিনা


এখানকার খাওয়াদাওয়ার কথা না বললে বর্ণনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ঠাণ্ডার জায়গা বলে এরা সাধারণত মাংসটা বেশি খায়। ভেড়ার মাংসের সুস্বাদু কাবাব প্রায় সব রেস্তোরাঁয় বিক্রি হয়। এছাড়া মিট পাসান্দা, মেথি কিমা, রোগন-জোস, ইয়াখনি পোলাও বিখ্যাত। নিরামিষের মধ্যে রাজমা, শ্রী পোলাও, লাদিয়ার জামান, নাদির ইয়াখেঁর স্বাদও লা-জবাব। আমরা যেমন রান্নায় ধনে পাতা আর দক্ষিণীরা কারিপাতা ব্যবহার করে, এখানে স্থানীয় কোনও পাতা ব্যবহার করে, যার জন্য একটা বিশেষ গন্ধ হয়, নামটা জানতে পারিনি। আর দারচিনি, মেথি, লবঙ্গ, জায়ফল ও আরও কিছু গুঁড়ো করে মেশানো হয় বিশেষ রান্নায়, তাতেই অপূর্ব একটা স্বাদ ও গন্ধ আসে।

চিত্র-২৩>কাশ্মীরী ওয়াজওয়ান থালি; ফটো-গণমাধ্যম

প্রত্যেক দেশ ও জাতির ভাষা ও পোশাকের মতোই রান্নার স্বাদ ও গন্ধের বৈচিত্র্যও অনন্য। মিষ্টির মধ্যে এরা ফিরনি, সিমাইয়ের ঘন পায়েস আর ক্ষীরের বরফি জাতীয় শুকনো মিষ্টি খায়। যদিও হলদিরাম-এর কল্যাণে এখন সর্বত্র লাড্ডু ও শোনপাপড়ি সহজলভ্য, কিন্তু আমি কেবল স্থানীয় মিষ্টির কথাই বলছি। তবে আমার মন কেড়েছে কাহওয়া, কাশ্মীরী স্পেশাল চা। চা না বলে একে বিশেষ আয়ুর্বেদিক গরম পানীয় বলাই যুক্তিসঙ্গত। দলের অনেকেরই নতুন দ্রব্য চেখে দেখায় আপত্তি ছিল বলে দলের সঙ্গে কাহওয়ার স্বাদ নেওয়া হয়ে ওঠেনি। শিকারা বোটে আধশোয়া হয়ে পাহাড়-ঘেরা ডাললেকের সৌন্দর্যে মগ্ন হয়ে আছি, তখন পাশ থেকে সরু ডিঙ্গি নৌকা বেয়ে ধূমায়িত কাহওয়া নিয়ে সাধাসাধি করতে লাগল। আহা, ঝিলের বুকে ভেসে দশ রকম সুগন্ধি মশলা, কাজু-কিশিমিশ-শুখা গুলাব কি পাংখুরি যুক্ত সেই চায়ে চুমুক দেওয়ার আবেশ কি লিখে বোঝানো যায়? আমাদের কলকাতার ফ্ল্যাটের নিচে ভন্ডুল-এর চায়ের দোকানের পাঁচ টাকার কাপের মাপে কাহওয়া ৫০ টাকা চাইল। দরাদরির শেষে তা ৩০ টাকায় নামলো, সঙ্গে দৃপ্ত ঘোষণা—“ইসসে কম কিসিসে নেহি মিলেঙ্গে!”

আগাম প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়ে হঠাৎ মেহেমান এসে গেলে এরা কী দিয়ে আপ্যায়ন করে মেহেমানওয়াজি দেখায়, সেটা দেখার জন্য একদিন মহিলামহলের সঙ্গে শপিং না গিয়ে থেকে গেলাম হাউজবোটে। উদ্দেশ্য, একান্তে খানিকটা বিশ্রাম নেওয়া। যা দেখেছি, তা মনের মণিকোঠায় গেঁথে নেওয়া। হাউজবোটস-এর কেয়ারটেকার ফারুক আমি দুপুরে লাঞ্চ নেব জেনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কারণ ওদের সঙ্গে কেবল সকালের নাস্তা আর রাত্রের খাবার দেওয়ার চুক্তি হয়েছে। দুপুরবেলাটা আমাদের বাইরে খেয়ে নেওয়ার কথা। তা সে তড়িঘড়ি এসে বলল, “ম্যাডাম, কুছ ভী চলে গা?” আমি খুশি, “কুছ ভী… তুম রোজ য্যায়সা খাতে হো, ওঅ্যায়সা হী কুছ লানা।” জী জী বলে ও চলে গেল। দুপুরে আনল কাশ্মীরী পুলাও। যত রাজ্যের বাদাম আর শুকনো ফল দেওয়া হয়েছে, কাজু, আখরোট আর পেস্তা বাদাম, কিশমিশ, শুকনো খেজুর, পাম, এপ্রিকট, আনারস আর আপেলের টুকরো আর প্রচুর শুকনো মটরশুঁটি। ছোট ছোট চাল। ওখানকার স্থানীয় চালের ভাত, সে এক ভুরভুরে সুগন্ধী ব্যাপার। সঙ্গে দিল দই, পিঁয়াজ আর গোলমরিচের রায়তা। ব্যাস, আর কিছু না। তৃপ্তি করে খেলাম। রেসিপি লিখতে বসিনি। অতএব কী দিয়ে কেমন করে, বলতে পারব না। আমরা যখন ছোট ছিলাম, মা বাসি ভাত ভেজে ঘরোয়া পোলাউ তৈরি করে দিত। শীতের সময় ফুলকপি, গাজর, মটরশুঁটি, পড়ত তাতে। কী যে অপূর্ব স্বাদ হত তার! মনে পড়ে এম এস সি পড়ার সময়ও মা অমন ভাত ভেজে টিফিন বক্সে দিত। অনেক সকালে ট্রেন ধরে বনহুগলি থেকে বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ যেতে হত। প্র্যাকটিকাল ক্লাস আরম্ভ হত সকাল আটটায়। ৬-১৫-র ট্রেন ধরতে ঘর থেকে বেরোতাম ভোর ছটার সময়। এক কাপ চা ছাড়া কিছুই মুখে দেওয়া হত না। আমি তৈরি হতে হতে মা আগের দিনের গুছিয়ে রাখা সবজি আর বাসি ভাত ভেজে দিত। প্র্যাকটিকাল ক্লাস শেষ হলে চারতলায় ক্যান্টিনের এক কোণে বসে টিফিন বক্স খুলে দেখতাম হলুদ পোলাউয়ের উপরে ধবধবে সাদা একটা ডিমসেদ্ধ। মাতৃস্নেহের শ্বেতপদ্ম যেন! ফারুখের দেওয়া পোলাউ দেখে মায়ের সেই চটজলদি ভাতভাজার কথা মনে পড়ল, চোখের কোণ ভিজে উঠল।

আগামীকাল গুলমার্গ যাব, সকাল সকাল বেরোতে হবে, তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম।

দিন ৫- ফুলের জলসায়—গুলমার্গের পথে

চিত্র-২৪>গুলমার্গের পথে সমগ্র উপত্যকা জুড়ে ফুল ফুটে আছে; ফটোস্বত্ব-লেখক

আজকের গন্তব্য গুলমার্গ, রাত্রিযাপন করব না, প্রধান উদ্দেশ্য গুলমার্গের সবচেয়ে আকর্ষণীয়—গণ্ডোলা কেবল-কার রাইডিং। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে পাউরুটি, জ্যাম নিয়ে নেওয়া হল। বাসে যেতে যেতে সেসব খাওয়া হল। পথে চা-পানের বিরতি টাংমার্গে, চেখে দেখলাম কাশ্মীরী নুন-চা। শ্রীনগর থেকে গুলমার্গের দূরত্ব ৫১ কিমি, পৌঁছাতে দেড়-দু’ঘন্টা সময় লাগে। রাস্তার দুধারের চোখজুড়ানো দৃশ্য দেখতে দেখতে চলেছি, বাসের গতি ধীর, অতএব ছবি তুলতে অসুবিধা হচ্ছে না। গুলমার্গের যত কাছাকাছি আসছি, সমস্ত পথে ফুল বিছানো, ‘গুল’ মানে ফুল, আর ‘মার্গ’ হল পথ। তাই এই নাম। সাদা, হলুদ, লাল, বেগুনী কত যে রংবাহারি ফুলের চাদর ঢেকে রেখেছে সমগ্র উপত্যকা! বাস চলছে চড়াই উৎরাই ধরে, পাহাড়ের গা বেয়ে, আঁকাবাঁকা পথে। মনের চোখ দিয়ে দেখো হে পাঠক, এ যে অনির্বচনীয়, বচনে প্রকাশ করা যাবে না! এই প্রসঙ্গে বলি, কাশ্মীরী পোশাকও চোখের ‘ট্রিট’।

হাওয়া মে উড়তা যায়ে, মেরা লাল দুপাট্টা মলমল কা…

চিত্র-২৫>তিন ধরনের কাশ্মীরী সালোয়ার-কামিজ; ফটোস্বত্ব-লেখক


এখানে পোশাক ভারি সুন্দর। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পোশাক সুতো বা এপ্লিকের কারুকাজ করা কুর্তা-পাজামা, মাথায় কাজ করা টুপি, পা-ঢাকা ক্যাম্বিসের পাম্প-স্যু, সেখানেও নক্সা-কাজ, পুরুষের পোশাকও ঢিলা পায়জামা অথবা চোস্ত চুড়িদার, কাজের সময় সাধারণ পাঞ্জাবী আর পরবের সময় কাজ করা জমকালো শেরওয়ানী। মাথায় সবারই নেহেরু টুপি থাকে। মেয়েদের হাতে, কানে, গলায় প্রচুর ঝুটো পাথরের আর মিনা কাজের গয়না, চোখে সুর্মা, ফুলের উপত্যকায় এরাও যেন রংবাহারি ফুলই। যদিও সাধারণ ভাবে দেখলে মনে হয় ওদের ছেলে-মেয়ে সব্বাই সালোয়ার কামিজ পরে, কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে সেই সালোয়ার আর কামিজের মধ্যে অঞ্চলভেদে ছোটখাট বৈচিত্র্য আছে। ওরা বলে, মূল কাশ্মীরের ছয় ভাগ, (১) গিলগিট (বালটিস্তান), (২) আকসাই চীন, (৩) লাদাখ, (৪) জম্মু, (৫) আজাদ কাশ্মীর, এর পূব দিকটা ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত, কার্যত অঞ্চলটি পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি স্বশাসিত অঞ্চল। (৬) কাশ্মীর ভ্যালি—সাধারণ পর্যটকদের ঘোরাঘুরি এখানেই। কাশ্মীর নিয়ে নানা রাজনৈতিক বিতর্ক এখানে আলোচনার বিষয়বস্তু নয়, লাল চকের (বাজার) এক পোশাক বিক্রেতার কাছ থেকে কাশ্মীরী পোশাক সম্পর্কে খানিকটা জ্ঞান সঞ্চয় করেছি, সেটাই বলি। ডিজাইনের সূক্ষ্ম পার্থক্য অনুসারে কাশ্মীরী সালোয়ার কামিজের প্রায় ন’রকমের বৈচিত্র্য—(১) গিলগিটি, (২) হুনজা-এতে সালোয়ারের বদলে থাকে ঘাগরা, (৩) বালটি, (৪) পাহাড়ি, (৫) কোশুর, (৬) গুজরি, (৭) ডোগরা-এর পায়ের অংশটি ঢিলা সালোয়ারের পরিবর্তে চোস্ত চুড়িদার, (৮) লাদাখি, (৯) কার্গিলি-এদের পোশাকের তিনটি অংশ, ঢিলা সালোয়ারের সঙ্গে লম্বা কামিজ ও উপরে পৃথক জ্যাকেট, মাথার টুপিটাও বেশ জবরদস্ত। মনে হয় ঠাণ্ডা বেশি হওয়ার জন্য এই এলাকার পোশাক এমন। একটা ছবি রইল তিন ধরনের কাশ্মীরী সালোয়ার-কামিজের।

গণ্ডোলা কেবল কার রাইড


পৌঁছলাম গুলমার্গের গন্ডোলা কেবল-কার রাইডের বেস স্টেশনে। সময় বাঁচাতে আগে থেকেই অনলাইনে টিকিট সংগ্রহ করা হয়েছিল। গুলমার্গ ভ্রমণে পর্যটক-আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এই কেবল কার রাইড। এশিয়ায় বৃহত্তম ও বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম ও দ্বিতীয় উচ্চতম কেবল কার প্রজেক্ট এটি। দুই ভাগে বিভক্ত সম্পূর্ণ যাত্রা পথ। প্রথম ভাগে গুলমার্গ রিসোর্ট থেকে ২৬০০ মিটার উচ্চতায় কংডোরি স্টেশন, পৌঁছাতে সময় লাগে ৯ মিনিটের মত। এই ফেজ-এর টিকিট মূল্য ৭০০ টাকা। একটা বাটির মত আকারের উপত্যকা, নয়ন মনোহর দৃশ্য। বেশি উঁচুতে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কম থাকায় যাদের শ্বাসের কষ্ট হয়, কিম্বা অন্য কোন শারীরিক সমস্যা আছে, তারা দ্বিতীয় ফেজ-এ না গিয়ে এখানেই নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করে ফিরতি গন্ডোলায় নিচে নেমে যেতে পারেন।

দ্বিতীয় ফেজ-এ গন্ডোলা নিয়ে যায় কংডোরি স্টেশন থেকে কংডোরি পাহাড়ে (৩৭৪৭ মিটার) আফারওয়াত শৃঙ্গের কাঁধের উপরে, পৌঁছাতে সময় লাগে ১২ মিনিট। জম্মু-কাশ্মীর গভর্নমেন্টের সঙ্গে একটি ফরাসী সংস্থা পোমাগালস্কি-র যৌথ উদ্যোগে এই কেবল-কার প্রোজেক্ট সম্পূর্ণ হয়েছে এবং ২৮ মে ২০০৫ থেকে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে। গণ্ডোলা বা কেবল-কার যখন ধীরে ধীরে উপরে ওঠে, দুধারে ক্রমে নিচে পড়ে থাকা ফুলে ফুলে ঢাকা পাহাড়ি উপত্যকা পেরিয়ে উপরের অপেক্ষাকৃত রুক্ষ-বরফিলা পর্বতশিখরের দৃশ্য উন্মোচিত হতে থাকে, সেইসঙ্গে ক্রমশ শীতলতর হয়ে আসা বাতাসের শিরশিরানি, সে এক অভূতপূর্ব অনুভূতি! উপরে ওঠা ও নিচে নামা—গন্ডোলা চলাচলের সম্পূর্ণ সময় যদিও সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত, কিন্তু আবহাওয়া খারাপ হতে আরম্ভ করলে যাত্রীদের দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ার জন্য মাইকে ঘোষণা হতে থাকে। অনেক ছোট ছেলেমেয়েরা এসেছে দেখলাম বাবা মায়ের সঙ্গে। অত উঁচুতে পাহাড়চূড়ায়ও ভ্রমণার্থীদের জন্য বিক্রি হচ্ছে ম্যাগি, কাহওয়া, চানা মশলা, আপেলের জুস এই সমস্ত। লাইনে দাঁড়িয়ে গন্ডোলার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমিও কিনে ফেললাম চানা মশলা, কলকাতায় লোকাল ট্রেনে যে প্যাকেট দশ টাকায় পাওয়া যায়, ওখানে তাই বিকোচ্ছে ৫০ টাকায়।

চিত্র-২৬>পাহাড়-চূড়ায় চানা-মশলা; ফটোস্বত্ব-লেখক

আমাদের সহযাত্রী এক সৈনিক, উপরের স্টেশনে ডিউটি বদল করতে যাচ্ছিলেন, বাঙালি শুনেই বললেন, “উরি বাবা! অনেক সুন্দর! আমি তোমাকে ভালোবাসি!” আমরা হেসে উঠলাম, সেই গানটা মনে পড়ল, আমাদের ছেলেবেলায় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, “আংরেজি মে কেহতা হ্যায় কি আই লাভ ইউ…আউর বাঙ্গালী মে কেহতা হ্যায় আমি তোমাকে ভালোবাসি!” ঘুরতে বেরিয়ে বাঙালির দেখা পাওয়া যায় সর্বত্র—পুরি, দার্জিলিং থেকে আরম্ভ করে সুইজারল্যান্ড, শিকাগো পর্যন্ত। ঘণ্টাখানেক পরে নিচে নেমে একটা পাঞ্জাবি ধাবায় খানা খেলাম। দাম প্রায় প্রত্যেক জিনিসেরই ডলারের হিসাবে। বিদেশে যেমন পাঁচ ডলারের নিচে কিছু নেই, এখানেও ৫০ টাকার কমে কিছু নেই। ডাল-ভাত খাওয়ার খরচ ১৫০-২৫০ টাকা।

চিত্র-২৭>আফারওয়াত ভ্যালি; ফটোস্বত্ব-লেখক


চিত্র-২৮>মেঘের মধ্যে দিয়ে চলেছে গণ্ডোলা; ফটোস্বত্ব-লেখক
কেনাকাটা


বিকেল চারটে নাগাদ শ্রীনগর ফিরে এলাম, সন্ধ্যা হতে এখনও দেরী আছে, তাই মঞ্জুর নিয়ে গেল ওর বন্ধুর দোকানে, শপিং করাতে। আমাদের প্রচুর সময় দিয়েছে মঞ্জুর, সারা রাস্তা সব জায়গা সম্বন্ধে বলতে বলতে এসেছে। আবার রাজেশ খান্না স্টাইলে নেচেও দেখিয়েছে। খুবই আমুদে মানুষ। এত পরিশ্রমের পিছনে ওর এই স্বার্থটুকু ছিল, সেটা মেনে নিতেই হয়। কাশ্মীর এতদিন পর ট্যুরিস্টের মুখ দেখছে। খানইয়ান বাজারে দোকানের নাম ‘কাশ্মীর ফ্যাশন’, বন্ধু বিরাট ধনী ব্যবসায়ী। ভদ্রলোকের বিরাট এক তেতলা হোটেল কাম রেস্টুরেন্ট-এর ব্যবসা, তারই একটি ঘরে শাল, পশমিনা, সালোয়ার-স্যুট পিস নিয়ে পশরা সাজিয়েছে ট্যুরিস্টদের খাতিরে। আমাদের খাতিরদারিও হল ঠাণ্ডা-পানি, চা-বিস্কুট সহযোগে। ন্যায্য দাম, তাই সকলেই কিছু না কিছু কিনলাম। মঞ্জুরের কমিশন পাওনা, সেটা বোঝা গেল। অল ইজ ওয়েল। ভ্রমণ-পর্ব সমাপ্তির মুখে। আবার ফিরতে হবে গতানুগতিক জীবনে।

এবার ফেরার পালা। পাঁচদিনের কাশ্মীর সফরে দুচোখ ভরে দেখেছি, মনপ্রাণ দিয়ে অনুভব করেছি, অসংখ্য ছবি তুলেছি। জাহাঙ্গীর কাশ্মীরকে ভূস্বর্গ বলেছেন, তা সত্য তো বটেই, তবে যখন প্রিয়তম মানুষ সঙ্গে থাকে, দেহ-মন সুস্থ সবল থাকে, তখন পাতার কুটিরের ফোঁকর গলে আসা চাঁদের আলোও পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্য বলে মনে হয়। ‘হামিন আস্ত-ও’, স্বর্গ এখানেই— একথা কতবার মনে হয়েছে কলকাতার বুকে গঙ্গার ঘাটে সূর্যাস্ত দেখে, পুরীর সমুদ্রে সূর্যোদয় দেখে, বেতলার জঙ্গলের ফরেস্ট বাংলোয় ঝিঁঝিঁ ডাকা অন্ধকারে তারার সামিয়ানার নিচে, আলমোরায় পাইন-বনের ঘন ছায়াময় সন্ধ্যায়, কিম্বা মায়ামির উজ্জ্বল সমুদ্রসৈকতে বা শিকাগোর শান্ত নদীবক্ষে নৌবিহারের সময়। আসল হল মনের চোখ আর দেখার মন। তাহলেই স্বর্গ তোমার চোখের সামনে।


প্রয়োজনীয় তথ্য-সংগ্রহ:
1. Kashmir: History, People, Conflict, Map and Facts; www.britanica.com
2. Jammu and Kashmir: Official Portal; www.jk.gov.in
3. The 14th World Conference on Earthquake Engineering ; Paper by V.R.Shah and Riyaz Tayiibji> Kashmir House.
4. The Wonder That Was Kashmir by Subhash Kak.
5. Shankaracharya Temple from wikipaedia.
6. Adi Shankracharya’s Visit to Kashmir By Onkar Aima (paper available in internet).
7. Blood and Toirism in Kashmir By Mehboob Jeelani (do).
8. About Shikara: Blog-‘A Revolving Compass’.
9. About Gondola Riding: www.traveltriangle.com
10. Gurudwara Mattan Sahib: www.worldgurudwaras.com

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

3 thoughts on “travel-kashmir

  1. অসাধারণ বর্ণনা। মন ভরে গেল। আমি দুবার কাশ্মীর ভ্রমণ করেছি।প্রথমবার বৈষ্ণোদেবী সহ কাশ্মীর, দ্বিতীয়বার চারধাম করার সময়ও কাশ্মীরের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি।আপনার সুবর্ণিত অধিকাংশ জায়গা ছায়াছবি হয়ে মনের চোখে ভেসে উঠলো। বেশ কষ্ট ও যত্নের সাথে লেখা এই ভ্রমন কথা একটি দলিল হয়ে থাকবে। কারণ অনেক তথ্য সম্বলিত এই লেখা ।
    আর এটি কথা, ”মাতৃস্নেহের শ্বেত পদ্ম” পড়তে পড়তে আমার চোখ ও ভিজে উঠলো। তার পর দেখি আপনিও সে কথা বলেছেন।
    আপনি কথাশিল্পী হয়ে বিরাজ করুন এই শুভেচ্ছা জানাই।

  2. Darun laglo, jeno bornona noy, ami uposthit sekhane। Lekhati pore kashmir jabar ichha probol holo। Anek shuvechha ar valobasa janai।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *