travel-rodin-museum

রঁদ্যা মিউজিয়ামের শিল্পদুনিয়ায়…
রাখী নাথ কর্মকার

Rodin Museum

ফিলাডেলফিয়ার এই সুরম্য জাদুঘর ‘রঁদ্যা মিউজিয়ামে’ প্রবেশ করার আগেই অবশ্য আমাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে গিয়েছে ‘দ্য থিঙ্কার’ ভাস্কর্যটির সঙ্গে, যা সম্ভবত রঁদ্যার সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সুপ্রসিদ্ধ ভাস্কর্যগুলির মধ্যে একটি। নিরিবিলি জাদুঘরের সামনে উঁচু বেদীর স্তম্ভে উপবিষ্ট ‘দ্য থিঙ্কার’, যেন পাথরের বুকে মূর্ত করে তোলা হয়েছে জীবনের দ্যোতনা। অসাধারণ দেহসৌষ্ঠব, নিরাভরণ শরীরের বলিষ্ঠ মানুষটির একটি হাত রাখা রয়েছে হাঁটুর ওপরে, অন্য হাতের তেলোয় থুতনি রেখে মানুষটি গভীর চিন্তায় নিবিষ্ট। ‘থিঙ্কারে’র শরীরের প্রতিটি মাংসপেশীতে যেন তরঙ্গায়িত হচ্ছে চিন্তার বলিষ্ঠতা! চিন্তা তো আসলে সমস্যা থেকে উত্তরণের স্তর, নিজেকে আবিষ্কার করার স্তর! রসজ্ঞ সমালোচকদের মতে, ব্রোঞ্জ-মার্বেলের এই ভাস্কর্য আসলে আমাদের ভাবতে শেখায়। জ্ঞান, দর্শনের নিরুচ্চারিত আলোর খেলা স্পষ্টই দৃশ্যমান ওই মূর্তির চোখের তারায় তারায়। পাথরের সুকঠিন শরীর খোদাই করে ফুটিয়ে তোলা এ এক চিন্তামগ্ন জ্ঞানীর নিবিড় অনুভূতি, তার ভাব-গম্ভীরতা ও আবেগের খুঁটিনাটি যেন তার মুখের প্রতিটি খাঁজে খাঁজে সুস্পষ্ট! সুদক্ষ শিল্পীর মায়াবী জাদুর ছোঁয়ায় যে পাথরেও প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়…এই ভাস্কর্যটি তারই প্রমাণ। সারা পৃথিবীতে এই ‘থিঙ্কারে’র অসংখ্য প্রতিলিপি ছড়িয়েছিটিয়ে আছে, সেগুলির মধ্যে বেশ কিছু ভাস্কর্য আবার রঁদ্যার মৃত্যুর পরেও নির্মিত হয়েছিল। রঁদ্যার আসল ভাস্কর্যটি বর্তমানে প্যারিসের রঁদ্যা মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে। এলসনের ভাষায়, ‘দ্য থিঙ্কার’ আসলে শিল্পের প্রতীক। ‘দ্য থিঙ্কার’ হল সেই মানুষের প্রতীক যে বুদ্ধিশীল, কিন্তু আবেগতাড়িত।
Sideboard

রঁদ্যা মিউজিয়ামের গেটের ব্রোঞ্জ দ্বারা সজ্জিত অ্যালকোভ খিলানগুলি যেন মৃদু, শান্ত গাম্ভীর্যে আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। গেট পেরিয়ে, আমরা ভিতরের আঙিনার ফ্রেঞ্চ বাগানে প্রবেশ করলাম। সুন্দর কেয়ারী করা বাগান, সযত্নে লালিত সবুজের ক্যানভাসে মিউজিয়ামের দৃপ্ত চাহনি! এই বাগানেও রঁদ্যার বেশ কিছু ভাস্কর্য গাছপালার শান্তশীতল ছায়ায় সাজিয়ে রাখা আছে।

এই মুহূর্তে আমাদের সামনে শোভা পাচ্ছে দান্তের ‘দিভাইনা কম্মেদিয়া’র অনুপ্রেরণায় তৈরি রদ্যাঁর মাস্টারপীস – প্রায় ২০ ফুট উঁচু ‘দ্য গেটস অফ হেলে’র বিস্তৃত প্রবেশদ্বার। প্রায় দুশোটির বেশি মানব মূর্তি দিয়ে পরিপূর্ণ এই বিশাল ব্রোঞ্জের সৃষ্টি দেখে আশ্চর্য হয়ে থমকে গেলাম আমরা। ‘দ্য গেটস অফ হেলে’র ঠিক ওপরেই রয়েছে ‘দ্য থ্রি শেডস’এর মিনি সংস্করণ, সেই সঙ্গে তার নিচেই রয়েছে একটি ছোট্ট ‘দ্য থিঙ্কার’এর মূর্তি, যা চারপাশে বিভিন্ন অভিব্যক্তিপূর্ণ মানুষের দ্বারা বেষ্টিত। ‘দ্য থিঙ্কার’এর মূর্তিই অবশ্য এই গেটের কেন্দ্রবিন্দু! শুনেছিলাম রদ্যাঁ নিজের হাতে যে তিনটি ‘গেটস অফ হেল’ তৈরি করেছিলেন, তার মধ্যে এটি অন্যতম!

রদ্যাঁ মিউজিয়ামের গর্ভগৃহে রয়েছে শিল্পকলার অপার সমাহার! ব্রোঞ্জ, প্লাস্টার আর মার্বেল পাথরে নির্মিত রঁদ্যার প্রায় দেড়শোর কাছাকাছি ভাস্কর্যের সংগ্রহ রয়েছে এই মিউজিয়ামে। রয়েছে নানা প্রিন্ট, চিঠিপত্র, তাঁর স্কেচ ইত্যাদিও!

এখানে দুটি গ্যালারি রয়েছে, বিশাল বিশাল ঝকঝকে জানালা এবং স্কাইলাইটের উজ্জ্বলতায় ঝলমল করছে গ্যালারির অভ্যন্তরভাগ। প্রধান গ্যালারিটির মূল আকর্ষণ হল রঁদ্যার বিতর্কিত সৃষ্টি ‘দ্য কিস’। দান্তের চরিত্র ফ্রান্সেসকা ও পাওলোর অনুপ্রেরণায় নির্মিত এই আলিঙ্গনাবদ্ধ দুই প্রেমিক-প্রেমিকার চিরন্তন প্রেমের প্রস্তরীভূত অবয়ব। প্রাথমিক ভাবে এটি অন্যান্য বিখ্যাত ভাস্কর্যগুলির মতো ‘দ্য গেটস অফ হেলে’র অংশবিশেষ হিসেবে নির্মিত হলেও পরে এটি একটি স্বাধীন ভাস্কর্য হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
The Gates of Hell

মিউজিয়ামের গ্যালারির দেয়ালগুলি মোম, মাটি, প্লাস্টার এবং ব্রোঞ্জ দ্বারা নির্মিত রঁদ্যার বিভিন্ন ভাস্কর্য দিয়ে সাজানো রয়েছে। সেগুলির মধ্যে কিছু আবার সম্পূর্ণ ভাস্কর্য তৈরি হওয়ার আগের প্রাথমিক অবস্থাতেই বিরাজ করছে। সমস্ত গ্যালারি জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে মানুষের ‘হাতে’র প্রতি রঁদ্যার মুগ্ধতার নিদর্শন…মানুষের হাতের নানা ভঙ্গিমা…! কী সুষমামন্ডিত ভাবে যে সামান্য দুটি হাতকে উপস্থাপন করা যায়, সামান্য দুটি হাতের বিভঙ্গের মধ্যে দিয়ে শুধু আনন্দই নয়, দুঃখ, ক্ষুব্ধতা এমনকি সমবেদনাও যে মূর্ত হয়ে উঠতে পারে তা এখানে না এলে আমরা অনুভবই করতে পারতাম না!

এই যেমন ‘দ্য ক্যাথিড্রাল…এই অসাধারণ ভাস্কর্যটি আমাদের বিহ্বল করে দেয়। ঐ যে…দুটি পরস্পর সংযুক্ত ডান হাত স্পর্শ করে রয়েছে একে অপরের দশটি আঙ্গুল! হাতদুটি কিন্তু দুটি ভিন্ন ব্যক্তির, কিন্তু কী নিবিড় মমতায় যে ওরা ছুঁয়ে রয়েছে একে অপরকে…দেখলেই মন এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে যায়…এ আসলে এক অন্তরঙ্গ সহাবস্থানেরই প্রতীক। মানব-বন্ধনের প্রতীক!

একটু এগিয়ে দ্বিতীয় গ্যালারিতে দেখলাম, সেখানে শোভা পাচ্ছে রঁদ্যার নির্মিত সেই যুগের বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং শৈল্পিক ব্যক্তিত্বের ব্রোঞ্জের প্রতিমূর্তি, যেমন ভিক্টর হুগো, জর্জ বার্নার্ড শ, বালজাকের মূর্তি। একটা সময় বিশ্ববিখ্যাত এই মহান ফরাসি ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকারের স্মৃতির উদ্দেশ্যে অসংখ্য ভাস্কর্য তৈরি করেছিলেন রঁদ্যা।

আসলে… ‘অগুস্ত রঁদ্যা’! শুধু শিল্পী বা নিছক ভাস্কর বললে তাঁর সবটুকু পরিচয় দেওয়া যায় কি? তিনি নিজেই যে এক প্রতিষ্ঠান, এক আদর্শ হয়ে উঠেছিলেন…তা তো অস্বীকার করা যায় না!

শুনেছিলাম, ফিলাডেলফিয়ার এক উদ্যোগী ব্যবসায়ী, চলচ্চিত্র প্রদর্শক জুলস ই. মাস্টবাউম ১৯২৪ সালে প্যারিস পরিদর্শনে গিয়েছিলেন এবং সেখানে রঁদ্যার কাজ দেখে তিনি রঁদ্যার এক গুণমুগ্ধ ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। তারপর নিজের উদ্যোগে মাত্র দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে তিনি রঁদ্যার বিভিন্ন ড্রয়িং ছাড়াও তাঁর মার্বেল, প্লাস্টার, ব্রোঞ্জের দুই শতাধিক ভাস্কর্য সংগ্রহ করেছিলেন, সেই সঙ্গে সংগ্রহ করেছিলেন রঁদ্যার বিভিন্ন চিঠিপত্র এবং বইও।

সেই সমস্ত অমূল্য সংগ্রহ নিয়ে মাস্টবাউম একটি যাদুঘর স্থাপনের পরিকল্পনা করেন এবং ১৯২৬ সালে তিনি ফরাসি স্থপতি পল ক্রেট এবং জ্যাক গ্রেবারকে রঁদ্যার জাদুঘর ভবন এবং বাগানের নকশা করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
The Thinker

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হল, প্রকল্পটি শুরু হওয়ার আগেই মাস্টবাউম হঠাৎ মারা যান এবং তারপর তার স্ত্রী ইটা এবং তার তিন কন্যাই তাঁর এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছিলেন। রঁদ্যা মিউজিয়ামটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল ১৯২৯ সালে।

আসলে, সত্যি বলতে কী, অবশ্যই ফিলাডেলফিয়া মিউজিয়াম অফ আর্টের সুবিশালতার সঙ্গে এই রঁদ্যা মিউজিয়ামের তুলনা চলে না, কিন্তু এই ‘ছায়া সুনিবিড়’ মিউজিয়ামের বুক জুড়ে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছড়িয়ে রয়েছে, যা অন্য কোনও ব্যস্ত মিউজিয়ামের গমগমে উচ্ছলতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। আসলে, বিংশ ও উনবিংশ শতাব্দীর সুবিখ্যাত ভাস্করদের মধ্যে পাইয়োনীয়ার, আধুনিক ভাস্কর্যের পথিকৃত অগুস্ত রঁদ্যার কাজ দেখার ইচ্ছে লালন করে চলেছিলাম আমি বহু দিন ধরে। প্যারিসের বাইরে রঁদ্যার ভাস্কর্যের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ রয়েছে ফিলাডেলফিয়ার এই মিউজিয়ামেই…আর তা জানার পরই আর নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি। রঁদ্যার বিশ্ববিখ্যাত সৃষ্টিগুলি স্বচক্ষে দেখার অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে দিন গুনে গিয়েছি আমি…!

আর আজ, মুগ্ধ মুহূর্তে আমার সেই অপেক্ষা যেন সফল হল। চক্ষু সার্থক হল, মনও পরিপূর্ণ হল। হয়ত আবার সুযোগ পেলেই ফিরে আসব রঁদ্যার এই অসাধারণ শিল্পের পরিমন্ডলে, যেখানে বাস্তব আর শিল্পীর কল্পনা মিলেমিশে এক হয়ে যায়…প্রস্তরীভূত কল্পনারা মুহূর্তের মধ্যে আমাদের বিহ্বল করে তোলে…পাথরের বুকে জেগে ওঠে অজানা সব গল্প!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “travel-rodin-museum

  1. চমৎকার লিখেছ রাখী। আর ছবিগুলোও যথাযথ ও সুন্দর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *