binodan-smritir-studiopara-part-6

স্মৃতির স্টুডিওপাড়া – পর্ব ৬
ফিল্ম রিভিউ
প্রিয়ব্রত দত্ত


গ্রুপ থিয়েটার থেকে সিরিয়ালের পালাবদল


গত শতাব্দীর নয়ের দশকের শেষ পর্ব আর নতুন শতাব্দীর সূচনা লগ্নটি ছিল বাংলা টলি ও টেলি জগতের যুগ সন্ধিক্ষণ। ক্রমশ জনপ্রিয়তা বাড়ছে ধারাবাহিকের। নতুন প্রজন্মের পরিচালকরা কেউই শুরুতেই সিনেমার মতো বড় বাজেট আর ঝুঁকির দিকে পা বাড়াতে চাইছেন না। অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও একে একে সিরিয়ালের খাতায় নাম লেখাচ্ছেন। কেন? শুধুই কি দিনের শেষে ‘কাজ’ উদ্ধার করে মেকআপ তুলে ক্যাশ টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরার লোভে? তা নয়। তার কারণটা একটু তলিয়ে দেখলেই সেদিনের সেই চোরা স্রোতের উৎসটা খুঁজে পাওয়া যাবে।

রুপোলি পর্দার স্বপ্ন সুন্দর-সুন্দরীদের তখন জনসংযোগের একটা বড় প্ল্যাটফর্ম ছিল বাংলা বাণিজ্যিক থিয়েটার। তৎকালীন বাংলা সিনেমা জগতের প্রায় সব হুজ হু-রাই নিয়মিত অভিনয় করতেন হাতিবাগান থিয়েটার পাড়ার হলগুলিতে। রঙ্গনা, রঙমহল, বিশ্বরূপা, স্টার, মিনার্ভা, কাশী বিশ্বনাথ, সারকারিনা, এদিকে কলেজ স্ট্রীট শিয়ালদা অঞ্চলে প্রতাপ মঞ্চ, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট তখন উপচে পড়ছে বাংলা সিনেমার নায়ক নায়িকাদের সশরীরে, চর্মচক্ষে কাছ থেকে দেখার নেশায়। কারণ, ম্যাটিনি আইডলদের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস অনুভব করার জন্য ওই বোর্ড থিয়েটারের মঞ্চই ছিল একমাত্র মাধ্যম। দর্শকরা ছিলেন মূলত মফঃস্বল তথা গ্রাম বাংলার। স্টার তো ওঁরাই বানান। আজও।

এহেন সুখের সংসারে থাবা বসাল দূরদর্শন। উল্টো দিক দিয়ে দেখলে মানুষের সুবিধেও করে দিল বোকাবাক্সটি। সিরিয়াল নামক সোনার পাথরবাটিটি থেকে মানুষ ঘরে বসেই সৌমিত্র-শুভেন্দু থেকে শুরু করে প্রসেনজিৎ-তাপস-চিরঞ্জিতদের তৃপ্তির চামচে খাবলা করে ছেঁচে নিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর ঢেকুর তুলতে শুরু করল। মাইলের পর মাইল ঠেঙিয়ে কে আর রাত জেগে নাটক দেখকে কতকাতায় যায়! ফলে পাতলা হতে শুরু করল হাতিবাগানের কলতান।

এই সুযোগে বেহুলার বাসরে সাপ ঢোকার মতো, বাংলা বাণিজ্যিক রঙ্গমঞ্চে ঢুকতে শুরু করল সস্তা চটকের বেনোজল। শুরু প্রতাপ মঞ্চ থেকে। এখনকার সিনেমায় আইটেম নাম্বারের মতো বাংলা নাটকেও সেদিন গুঁজে দেওয়া হয়েছিল ক্যাবারে নাচ। ফলে বোর্ড থিয়েটার তার কৌলিন্য হারাতে শুরু করল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে গোটা থিয়েটার পাড়া জুড়ে কে কত অশ্লীল ক্যাবারে নাচের প্রদর্শন করতে পারে তার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। রুচিশীল শহুরে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকলেন। তারপর ধীরে ধীরে তারাও সন্ধ্যের পর টিভি নামক বিস্ময় বস্তুটির সামনে বাবু হয়ে বসতে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। দূরদর্শনও দ্রুত গ্রাম বাংলায় দুর্বার গতিতে খুঁটি পুঁততে শুরু করল।

বাংলা বোর্ড থিয়েটারের এই ক্রম অবনতির পেছনে ছিল এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবির ক্ষুরধার মস্তিষ্ক। বাম আন্দোলনের ধ্বজা উড়িয়ে আর শ্রমজীবি জনতার যাতনা বাসনার ক্যালাইডোস্কোপকে ক্যাশ করে গ্রুপ থিয়েটার নামক এক মহান আদর্শকে সমাজের সামনে তুলে ধরতে শুরু করা হতে লাগল সুকৌশলে। সেখানে শিক্ষা আছে সস্তা বিনোদন নেই। আদর্শ আছে আতিশয্য নেই। বাস্তবতা আছে বিড়ম্বনা নেই। এই রকম ইত্যাদি প্রভৃতি সত্য ও সুন্দরকে কুমির ছানার মতো তুলে ধরে এক নব নাট্য আন্দোলনের ধারাকে কায়দা করে শোষিত, বঞ্চিত তথা সর্বহারা সমাজের মুষ্টিমেয় বোদ্ধাদের বৈদগ্ধের বৈতরণী করে তোলা হতে লাগল। আকাদেমি কেন্দ্রিক এক আঁতেল গোষ্ঠির উদ্ভব হল, যারা বাণিজ্যিক বাংলা নাটককে নষ্টামি বলেই মনে করত। থিয়েটার করতে হবে কষ্ট করে। ত্যাগ স্বীকার করে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে। মানে নিজের ট্যাঁকের কড়ি খরচা করে। কেন? না তারা শোষণ ও বঞ্চনার কথা বলছেন। মত ও আদর্শের বুলি আওড়াচ্ছেন। সংগ্রাম ও শ্রেণির সূক্ষ বিভাজন রেখাকে সংলাপ আর সত্য দিয়ে সংবেদনশীল মানুষের সামনে তুলে ধরছেন। এখানে তুমি তোমার সব কিছু দিয়ে যাও, পাবার আশা করো না। কারণ তুমি কমিউনিস্ট, তুমি কালের যাত্রার পদাতিক। তারা কায়দা করে ভুলিয়ে দিল নব নাট্য আন্দোলনের মাইলস্টোন ‘নবান্ন’ নাটকটি কিন্তু অভিনীত হতো বাণিজ্যিক মঞ্চেই। গ্রুপ থিয়েটার যৌথ খামার। অভিনেতারাই মেকআপ আর্টিস্ট, তারাই সুরকার গীতিকার, এমনকি আলো ও আবহ প্রক্ষেপক। তারাই সেট ও কস্টিউম ডিজাইনার। তারাই আবার কাউন্টারে টিকিট বিক্রেতা। অর্থাৎ সবাই সবজান্তা।

ফলে হল কী বাংলা নাটকের এই নব্য ধারায় বাণিজ্যিক বাংলা নাটকের কলাকুশলীদের যেমন কোনও ঠাঁই হল না, তেমনই পাত্তা পেলেন না মাঝারি মানের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। ওদিকে বুদ্ধির বেতাজ বাদশারা ততদিনে প্রমাণ করে দিয়েছেন আমজনতা তাদের পক্ষেই। এই সর্বহারা শ্রেণির সৌজন্যেই তারা বিপ্লবকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাতিক্রমী বাংলা গড়ার লক্ষ্যে ক্ষমতার অলিন্দে পা রেখেছেন। সাফল্যের এই কন্টকাকীর্ণ পথে অন্যতম হাতিয়ার ছিল গণনাট্য আন্দোলন। তাদেরকে এবার পুরস্কৃত করা হোক।

সরকারি অনুদানের গন্ধ পেয়ে সাপের বাচ্চা জন্মানোর মতো গোটা বাংলা জুড়ে পিলপিল করে গ্রুপ থিয়েটার গজিয়ে উঠতে শুরু করল। নাট্যকর্মী বা কমরেডদের মাথায় এটাই গুঁজে দেওয়া হল যে এটা গ্রুপ থিয়েটার, গরিবের গাধাবোট। কিছু পাবার আশা নিয়ে এখানে পা রেখো না। সমাজ তোমার তিতিক্ষাটাকেই দেখতে চায়। দুয়োরানি হয়ে গেল থিয়েটার পাড়া। ওটা তো কমার্শিয়াল ইন্ডাস্ট্রি, ওদের সংস্থান ওরা নিজেরাই করে নেবে। ফলে সরকারি অনুদান ও পক্ষপাত বঞ্চিত একটা আস্ত ইন্ডাস্ট্রি ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে শুরু করল।

এহেন অবস্থায় টিভির দৌলতে সিরিয়াল নামক নয়া সংস্কৃতিকে তাই আঁকড়ে ধরল গোটা টালিগঞ্জ পাড়া। কলাকুশলী থেকে শুরু করে অভিনেতা-অভিনেত্রী সকলেই রুটি রুজির তাগিদে নাম লেখাতে শুরু করলেন ধারাবাহিকের জাবদা খাতায়। বাংলার অভিনয় শিল্পে স্পষ্ট বিভাজন রেখা তৈরি হয়ে গেল।

মজার বিষয় হল যে নব্য প্রজন্মের হাতে টালিগঞ্জের টেলি ইন্ডাস্ট্রি আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করল তাঁরা কিন্তু প্রত্যেকেই তথাকথিত গ্রুপ থিয়েটারেই মানুষ। মনে করে দেখুন বাংলা টেলিভিশনে প্রথম ধারাবাহিকটি সম্প্রচারিত হয়েছিল কাদের প্রযোজনায়? সোনেক্স। কাদের তৈরি সংস্থা? রমাপ্রসাদ বণিক, জগন্নাথ গুহ, শ্যামল সেন, জোছন (ঘোষ)দস্তিদার। এঁরা তখন ডাকসাইটে গ্রুপ থিয়েটারওয়ালা। ওঁদের শুরু যদিও বাংলা বাণিজ্যিক মঞ্চে। পরবর্তীতে দ্রুত কমার্শিয়াল তকমাটা নিজেদের শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলে গ্রুপ থিয়েটারের আলোক দিশারি হয়ে যান। ওঁদের অভিনয়-প্রতিভা, শিক্ষা, বোধ, প্রয়োগ কৌশল, বিষয় নির্বাচন নিয়ে কোনও প্রশ্ন তুলছি না। বরং দেখাতে চাইছি অচিরেই তাঁরা বুঝতে শুরু করেছিলেন বিপ্লব আর আদর্শ দিয়ে পেট ভরে না। বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম আর্থিক সংস্থান দরকার। চাই বিকল্প পথ ও উপায়। বুদ্ধিমান মানুষ। বুঝেছিলেন অডিও ভিসুয়াল অর্থাৎ দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমটি আগামীতে বিপ্লব নয়, বিস্ফোরণ ঘটাতে এসেছে। ‘তেরো পার্বণ’ বাংলা ফিল্ম ও টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির চোখ খুলে দিল।

কিছুদিন যেতে না যেতেই কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক প্রসার ভারতী নামে একটি সামিয়ানা তৈরি করে মুক্ত বাণিজ্যের অন্যতম ফল্গু ধারা হিসেবে খবর ও বিনোদন বিকোনোর জন্য বেসরকারি অডিওভিসুয়াল চ্যালেনের অনুমতি দিয়ে দিলেন। দূরদর্শনের পাশাপাশি এলো জি বাংলা, ইটিভি মতো ব্যাক্তি মালিকানাধীন বেসরকারি চ্যানেল। এর মধ্যে জি বাংলা তেড়েফুঁড়ে শুরু করলেও মাঝপথে হতোদ্যম হয়ে পড়ে। ফাঁকা জমিতে একা খেলতে শুরু করে রামোজি রাওয়ের ইটিভি। হায়দরাবাদে ভারতের প্রথম সর্বসুবিধা সম্পন্ন চোখ ধাঁধানো ‘ফিল্ম সিটি’ তৈরি করে বিনোদনের সংজ্ঞাটাই বদলে দিলেন দূরদর্শী মানুষটি।

কলকাতায় একান্তে রামোজি রাওয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বুঝেছিলাম মানুষটির বাংলার শিল্প সংস্কৃতি ওপর অগাধ ব্যুৎপত্তি। সম্মান করেন বাংলার সাংস্কৃতিক প্রতিভাকে। মানুষজনদের। ফলে তাঁর বিনোদন ব্যবসার অন্যতম হাতিয়ার হতে চলেছে বাংলা। গোটা ফিল্মসিটিটি তিনি তৈরি করেছিলেন তখনকার দিনের বলিউডের শীর্ষ আর্ট ডিজাইনার বঙ্গ সন্তান নীতিশ রায়কে দিয়ে। তাঁর উপরেই ছেড়ে দিয়েছিলেন বাংলার বিনোদন বাণিজ্যকে। শর্ত একটাই হায়দরাবাদে গিয়ে, থেকে, সেখানেই তৈরি করতে হবে বাংলা ধারাবাহিক। দুঁদে ব্যবসায়ী রামোজি রাও কলকাতায় এসেছিলেন রত্নের সন্ধানে।

এমন একটা সময় এল যখন টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ার একমাত্র গন্তব্য, হায়দরাবাদ। পরিচালক, কলাকুশলী, শিল্পী থেকে শুরু করে প্রযোজনা নিয়ন্ত্রকরাও তাঁবু ফেললেন হায়দরাবাদে। ইটিভির বঙ্গ অভিযান শুরু হল ‘মা মনসা’ নামে এক মেগা ধরাবাহিক দিয়ে। প্রযুক্তিগত কৌশল নির্ভর ঝকঝকে প্রযোজনা। চোখ ধাঁধিয়ে গেল সকলের। রোজগারও টালিগঞ্জের থেকে অনেক বেশি। শুধু একটাই অসুবিধে পরিবার পরিজন ছেড়ে দীর্ঘদিন ফিল্মসিটিতে পড়ে থাকতে হচ্ছে। ক্যান্টিনের খাবার ছাড়া অন্য কোথাও খাওয়া যাচ্ছে না। মাছে ভাতে বাঙালি কাঁহাতক আর ইডলি সাম্বার খেয়ে থাকতে পারে! সে যাই হোক। রোজগারটা তো ভালোই। দুদ্দাড়িয়ে ছুটল সব। এমন অবস্থা স্টুডিওতে তালা পড়ে যাবার জোগাড়। টিমটিম করে চলছে দূরদর্শনের কয়েকটি ধারাবাহিক। বাংলা সিনেমারও করুণ দশা। শিল্পী, টেকনিশিয়ান কই। সবই তো হায়দরাবাদে।

এরই মধ্যে কয়েকজন তরুণ রীতিমতো শিক্ষিত ও সংবেদনশীল পরিচালক অনুভব করলেন, আসলে তাঁরা এক একজন শ্রমিক ছাড়া আর কিছু নন। চিন্তা বা সৃজনশীলতার স্বাধীনতা নেই। নিজের মতো কিছু করার পরিসর নেই। পয়সা হয়তো আছে ঠিকই, কিন্তু নিজে একটা কিছু হয়ে ওঠার সুযোগ নেই। সব চেয়ে বড় কথা ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই।

এই তরুণ প্রজন্মের পাঁচ পরিচালককে আমি সেদিনও বলতাম, আজও খোলা গলায় বলি ‘ফ্যাবুলাস ফাইভ’। তাঁরা হলেন অনিন্দ্য সরকার, অভিজিৎ দাশগুপ্ত, দেবাংশু সেনগুপ্ত, কৌশিক গাঙ্গুলি ও যীশু দাশগুপ্ত। মিলন রায় চৌধুরী কিংবা অমল রায় ঘটক বা জগন্নাথ গুহদের প্রতিভা নিষ্ঠা মেধা আর সাফল্য মাথায় রেখেই বলছি।

এঁদের মধ্যে দুজন আজ আর নেই। দেবাংশু সেনগুপ্ত ও যীশু দাশগুপ্ত। বাংলা সিরিয়াল এখন চ্যানেলের অঙ্গুলি হেলনে চলে। পরিচালক মানুষটি এখন কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ। তার কোনও প্রভাব নেই গোটা প্রক্রিয়াটির উপর। চ্যানেল যে পাতাগুলো পাঠায় সেই দেখে তিনি শট নিয়ে যান। ব্যস, পরিচালক বলতে এখন এটাই বোঝায়। ওই পাঁচ পরিচালককে তখন প্রযোজকরাই কিছু বলার সাহস পেতেন না। এত দাপট। পরিচালকদের হাত থেকে ক্ষমতা যেদিন থেকে চলে গেছে সেদিন থেকে অনিন্দ্য সরকার আর অভিজিৎ দাশগুপ্ত পরিচালনা ছেড়ে অভিনয় করার দিকে মন দিয়েছেন। আর কৌশিক গাঙ্গুলি ও পথে পা-ই দেননি। তাঁর সিনেমাই প্রমাণ করে দিয়েছে সেদিন আমার পর্যবেক্ষণ ভুল ছিল না। এঁরা প্রত্যেকেই আমার চেয়ে বয়সে বড়। দাদা ভাইয়ের সম্পর্ক। প্রত্যেকে শিরদাঁড়াটা সোজা রেখে চলেন। এখনও। দুঃখ একটাই পাঁচজনের চারজনই এখন সমস্ত স্টুডিও পাড়া স্তব্ধ করে দিয়ে বলে ওঠেন না ‘অ্যাকশন’!

তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়েছে। এনটিওয়ান স্টুডিওতে কর্মপ্রত্যাশীদের ভিড় বাড়ছে। অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকুশলীরা শ্যুটিং সাময়িক বন্ধ রেখে টিফিন খাচ্ছেন। টিফিন মানে স্রেফ মুড়ি তেলেভাজা কিংবা এগ বা চিকেন রোল অথবা চাউমিন। আমার ভাগ্যে একটা চিকেন রোল জুটে গেছে। সঙ্গী ফটোগ্রাফার সন্দীপ দত্তকে সঙ্গে নিয়ে খবরের খোঁজে ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছি। আর রোলে কামড় বসাচ্ছি। আগে এনটিওয়ানে ঢুকে খানিকটা সোজা গিয়ে ডানপাশে একটা অফিস ঘর ছিল, সেখানে কয়েকজন মানুষের জটলা। পাশ কাটিয়ে ওপাশে ক্যান্টিনের দিকে যেতে গিয়ে হঠাৎ কানে এলো ‘ও যীশুদা… কতদিন আছ…?’ কে যীশুদা… ডান দিকে তাকালাম। দেখি গোটা মুখ এলোমেলো দাড়িতে ভর্তি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, পরনে খুবই ক্যাজুয়াল পোশাক, কুচকুচে কালো বিশাল বপু নিয়ে একজন কিম্ভূত দর্শন মানুষ দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছেন। পাশ দিয়ে তখনকার দিনের বিখ্যাত মেকআপ জুড়ি দিলীপ-দ্বিজেনের দিলীপদা যাচ্ছিলেন। ভীষণ মুখ খারাপ। কথায় কথায় খিস্তি করেন। আবার আমার অন্যতম সোর্স। খুব স্নেহও করেন। তাঁকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দিলীপদা উনি কোন যীশু গো?’ ছাপার যোগ্য নয় এমন কয়েকটি বেদবাক্য বর্ষিয়ে দিলীপদা বললেন, ‘নিশ্চয়ই বেথলেহেমের নয়… গিয়ে জিজ্ঞাসা কর…’ বলে কেটে পড়লেন। চুল দাড়ি সমেত মেহের আলি সদৃশ সেই ভদ্রলোকও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, দিলীপদার খিস্তির দৌলতে। পেছন থেকে মিম ওরফে সন্দীপ আমাকে ঠেলা মারল। আমি এগিয়ে গেলাম। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখতে দেখতে সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেটা ছুঁড়ে ফেলে জামার বুক পকেট থেকে ক্লাসিকের প্যাকেট বার করে সেখান থেকে আর একটা সিগারেট নিয়ে, অন্য পকেট থেকে পেট্রল লাইটার বার করে আঙুল ঘষে দপ করে আগুন জ্বেলে সিগারেটটা ধরিয়ে লাইটার নিভিয়ে গমগমে গলায় আমাকে বললেন, ‘আমার নাম যীশু দাশগুপ্ত। আপনি…?’

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *