micro-story-bagh-bondi

বাঘবন্দি
জোৎস্নালিপি


মানুষের জীবন সূর্যের আলো নয়; যে সোজাভাবে চলবে। কিংবা চাঁদ নয়: যে কোনো জায়গায় দাঁড়িয়েই মনে হবে– আমার মাথার ওপর রয়েছে। আমি হাঁটিছি সেও হাঁটছে। এসব শক্ত কথা তবুও বোঝে বিলাতি। কারণ তাকে বুঝতে হয়। সাহেবদের সঙ্গে ওঠাবসা করে সে শক্ত কথা বুঝতে শিখেছে।

পেটটার দিকে চোখ বুলিয়ে কেমন হাসি পায় তার। হাসির মধ্যেই চোখের কোণে দুএক ফোঁটা জল জমতে শুরু করে। পেটটাকে ভূড়িওয়ালা লোকের সঙ্গে তুলতে ইচ্ছে হয়।

মনে পড়ে ছেলেবেলার সেই ব্যাঙের গল্প। তার পেটটাও কি ধীওে ধীরে সেই পর্যায়ে চলে এসেছে। বেশিদিন মানুষের চোখকে ধূলো দেয়া অসম্ভব! সে নিঃসঙ্গ; তা নয়। মানুষ কখনও নিঃসঙ্গ নয়। তার ভিতরে বাস করে হাজারো মানুষ। মাথার কোষে কোষে থাকে মানুষ তৈরির যন্ত্র।

ইচ্ছে করলে যেমন চোর পুলিশ খেলা যায়, তেমনি খেলা যায় বাঘবন্দি। বাঘবন্দি করাটা একটু বেশি কষ্টের। গুটি খায়ও সে বেশি। গুটির জোট হওয়াটাও তেমনি কঠিন। যুগ যুগ ধরেই তা চলে আসছে। বাঘের পেট বড় হয় না কখনও। তবুও হাঙ্গরের মতো তার ক্ষিধে পায়; গিলতে থাকে টপাটপ। বাঘকে দোষ দিয়ে লাভ কি? একজন নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্যই এসব সৃষ্টি করেছেন। এখন আহার জোগাড় দিতে কষ্ট হয় তার! খুব বেশি কষ্ট। মাঝে মধ্যে অসুখের ভান করে থাকে। ক্ষিধে সে তো কথা শোনে না। নিয়মিত তার খাদ্য যোগান চাই।

কিন্তু সে এখন ক্লান্ত। সে মানে আমাদের শ্যামপুরের গফুর মণ্ডলের নাতনি বিলাতি। প্রায় রাতেই একটা বাঘ স্বপ্নে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। চেষ্টা করলে ওঠানো যায় না। একে একে খুলে পড়ে সব। কাপড়ের কালো লেশ খুঁজে পাওয়া যায় না। সকাল বেলা শুধু চোখে পড়ে জমে যাওয়া কালো রঙ। ততক্ষণে বাঘটা ক্লান্ত হয়ে পোষাপাখির মতো খাঁচায় ঢোকে। অলস ক্লান্ত দেহটা কোনো রকমে টেনে কাজে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করে বিলাতি। পারে। কষ্ট হয়। তবুও। তাদের না পারা বলে কোনো কিছু নেই! পারতে হয়! ইদানিং চাপটা বেশি সহ্য হয় না। সামনের দিকটা বেশি ফুলে যাচ্ছে।

অতঃপর ঘাড় ধাক্কা। আবার সেই শ্যামপুর। শুধু পার্থক্য এই যে– এখন গাছে চড়তে পাড়ে না! ছুটে বেড়াতে পারে না! উঠতে পারে না পেয়ারা গাছটার উঁচু ডালে। পড়শিরা মুখ টিপে হাসে। বাঁকা চোখে মুরুব্বীরা তাকায়। জোয়ানরা শিষ দেয় আর বাংলা ছবির অশ্লিল গান গায়। শুধু মা নিরবে চোখের জলে ফেলেন। তার চোখে জল নেই। মরুভূমি যেন। কোনোদিন সবুজ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই।

হাঁটতে খুব কষ্ট হয়। কাঁঠাল গাছের ডালে ঝুল খেলতে খুব ইচ্ছা করে। ছোট বাচ্চাদের দেখাদেখি সেও কাঁঠাল গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। ঝুলতে যায় গাছে ঝুলপিঁড়িতে। তাকে দেখে সবাই ছুটে পালায়। বাচ্চারা ছড়া কাটে। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে সে। একজন বৃদ্ধ হঠাৎ বলে ওঠে- ‘তুমি বাবু মান-সম্মান রাহলে না। আমার পেটের মিয়া হলি লবণ গালে দিয়ে সেই আঁচিঘরেই মারে ফেলতাম– যুগ জামানার যে কি হোলো।’

বাঘটা আবার তাকে চেপে ধরেছে। আরো জোরে, পেটটা বুঝি এবার ফেটেই যাবে। চিৎকার দিয়ে বিছানার উপর উঠে বসে সে। এই চিৎকার আগে সে দিতে পারে নাই। লোমকূপগুলো সক্রিয় হয়ে উঠে লোনা জল ছেড়ে দেয়। আঁচল দিয়ে মুখ মোছে সে। কলসি থেকে জল ঢেলে মুখে দেয়। ফুলে ওঠা পেটটার ওপর যত্নে হাত বুলোয়। তারপর নিঃশব্দে বের হয়ে যায়।

মুক্ত বাতাসের আশায় কাঁঠাল গাছের দোলনার উপর গিয়ে বসে। বিষাক্ত পৃথিবীর নিশ্বাস নিতে তার ভাল লাগে না। তবুও একবার সমস্ত বুক বাতাসে ভরে নেয়। ভীতরটা যেন একেবারে পুড়ে ওঠে। একটু শান্তি জন্য ঘুমিয়ে পড়ে সে।

চারিদিক সুন্দর আর সুভ্রতা। সামনে স্বর্গের দরজা। আর একটু এগোলেই সুখের সীমায় পৌঁছে যাবে সে। দরজা খুলে যায়– আবার সে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করে। ভিতরটা পুড়ে ওঠে। সামনে দেখে আরো ভয়ংকর এবং হিংস্র বাঘ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ওত পেতে আছে। তখন তার মনে হয় সেখানেই বোধহয় ভালো ছিলাম।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *