micro-story-gondho-bivrom

গন্ধ বিভ্রম
মোজাম্মেল হক নিয়োগী


গলির মুখে এলেই একরোখা ঝাঁঝালো একটা গন্ধ নাসারন্ধ্র ঠেসে ধরে।

এই গন্ধ এই গলির বা মহল্লার মানুষ আগে কখনো পায়নি বলে এটা কীসের গন্ধ তারা বলতে পারে না। কোনো প্রাণী মরা-পচার গন্ধ নয়, কোনো উদ্ভিদেরও নয়, তাহলে কীসের গন্ধ! কোন প্রাণী পচলে কেমন গন্ধ হয় এই মহল্লার মানুষ বুকে টোকা দিয়ে বলতে পারে। নতুন গন্ধটা কীসের বুঝতে বুঝতেই ক্রমে মহল্লার মানুষের নাক সওয়া হয়ে যায় এবং পরে তারা আবিষ্কার করে এই গন্ধ কোনো ক্যামিকেল পদার্থের। বাসাবাড়িগুলো ঠাসাঠাসি। এক দেয়ালের সঙ্গে আরেক দেয়াল মিশানো।

একদিন ফজল মাস্টার ক্যামিকেল গুদামের খোঁজ পেয়ে গুদাম সরানোর দাবি তোলেন। আবাসিক এলাকায় কেন ক্যামিকেল গুদাম? এটা হতে পারে না।

গুদামের মালিক কালা বাতেন ফজল মাস্টারকে দিনে দুইবার কিনে চার বার বিক্রি করতে পারে—অশেষ ক্ষমতা। শুধু কি নিজের? তার মাথার ওপর ছায়াদানকারী নেতাও আছে। একদিন ফজল মাস্টার কয়েক জন মুরুব্বি নিয়ে কালা বাতেনের দরজায় কড়া নাড়েন। কালা বাতেন হাসিখুশি মুখে তাদের আন্তরিক আপ্যায়ন করে জানতে চায়, কীয়ের লাইগ্যা আইলেন?

আবাসিক এলাকায় ক্যামিকেলের গুদাম থাকাটা ঠিক না। কোনো দিন আগুন লাগলে সব ভস্মীভূত হয়ে যাবে। গুদাম সরাতে হবে, ফজল মাস্টার বলেন।

কালা বাতেন হাসে, বলে, আপনাদের এখানে থাকতে অসুবিধা অইলে অন্যহানে যান। কথা পরিষ্কার।

মুখ কালো করে ফজল মাস্টার মহল্লার মুরুব্বিদের নিয়ে ফিরে যান। আর বলার কিছু রইল না যখন ফজল স্যার জানতে পারেন যে, তার মাথার ওপর একটি হাতের স্নেহের শীতল ছায়া আছে। এই শীতল ছায়াকে ভেদ করে কোনো উত্তাপই বাতেনের গায়ে লাগে না। এই স্নেহের শীতল ছায়ার মানুষটি রাজনীতিক আফজাল হোসেন। মহল্লার মুরুব্বিদের নিয়ে শেষ ব্যর্থ চেষ্টা করতে ফজল মাস্টার আফজাল হোসেনের বাড়িতে গিয়ে ক্যামিকেল গুদাম সরানোর কথা বললে তিনিও বলেন, দেশে শিল্পকারখানা না বাড়লে উন্নতি হবে কী করে? আপনাদের এখানে থাকতে অসুবিধা হলে অন্য গলিতে চলে যান। যুক্তি অকাট্য। ফজল মাস্টার হতাশ হয়ে অন্যদের নিয়ে ফিরে আসেন।

ঝাঁঝালো গন্ধটা ক্রমে মহল্লাবাসীর নাকসওয়া হয়।

রাত গভীর। গলির বাসার মানুষগুলো গভীর ঘুমে অচেতন। তাদের ঘুম ভাঙে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির সাইরেনের শব্দ শুনে। তারপর হুড়মুর করে সবাই বাসা থেকে নামতে শুরু করে। গলিটি আগুনের লেলিহান শিখা আর কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। চারদিকে আর্ত-চিৎকার ও চেঁচামেচি। বাঁচাও বাঁচাও বলে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি। হামিদা বানুও নিচে নেমে এসেছিল। হঠাৎ তার প্রতিবন্ধী ছেলেটার কথা মনে হওয়াতে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে আবার তেতলার বাসায় ফিরে। ছেলেটা ততক্ষণে দগ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছে। সাপের জিহ্বার মতো লক লকে আগুনের লেলিহান শিখা হামিদা বানুকেও মুহূর্তে ঘিরে ধরে। তার আর নিচে নামা হয়নি। ছেলের কাছেই কয়লার স্তূপের মতো পড়ে থাকে।

ঠাসাঠাসি বাড়ির কারণে ফায়ার সার্ভিসের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। ভোরের আলোয় সারা শহর উদ্ভাসিত হলে আগুন নিভে। শুরু হয় কয়লার মতো মানুষের লাশের গণনা। কোনো লাশকেই চেনা যায় না। বাতাসে মানুষ পোড়া গন্ধ ভাসছে।

নেতা এলেন। সবাইকে স্বান্ত্বনা দিলেন। তিনি বললেন, এই মহল্লায় আর কোনো দিন ক্যামিকেলের গুদাম থাকতে পারবে না।

মৃতদের কষ্ট মানুষ বেশি দিন মনে রাখে না। শোক ভুলে যায় খুব দ্রুতই। গলির মানুষেরা ফিরে আসে স্বাভাবিক জীবনযাপনে, কর্মব্যস্ততায় হারিয়ে যায় অগ্নিদগ্ধ মানুষগুলোর কথা।

একদিন আবার একটি বাসায় ক্যামিকেল পদার্থের গুদাম গড়ে ওঠে।

গলির মানুষেরা বিভ্রমে পড়ে—এই গন্ধ কি মানুষ পোড়ার নাকি ক্যামিকেলের।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *