micro-story-khomota

ক্ষমতা
মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়


প্রাচীর সমান লোহার গেট খুলে গেল। দীর্ঘ বারো বছর পর সংশোধনাগারের বাইরে এসে দাঁড়াল রুবি। আঃ! কত আলো! কী ঝলমলে আকাশ! বড় করে শ্বাস টানে সে। বুকভরে শ্বাস নেয়। এতগুলো বছরে প্রাণভরে শ্বাস নেয়নি, চোখ ভরে আলোমাখা আকাশ দেখেনি, শীতল বাতাস গায়ে মাখেনি।

কিন্তু এবার! কোথায় যাবে সে? ফেলে আসা বছরগুলোয় অভিজ্ঞতায় বুঝে গেছে বাড়িতে তার কোনও জায়গা নেই। নাহলে একটা দিনও কী বাবা, দাদা বা বৌদি এসে দেখা করত না? আজ কান্না পাচ্ছে রুবির। মা থাকলে সেদিনের তার অসহায়তার কথা ঠিক বুঝত।

সামনে তাকাতেই বুকের ভিতর থেকে কাঁপুনি আসে রুবির। তাপ্তী কাকিমা! তাহলে তার এতগুলো বছরের শাস্তিতে তিনি খুশি হননি? আজ এসেছেন নিজের হাতে শাস্তি দেবেন বলে? কাকিমা কী বোঝেননি, এতগুলো বছর রুবির জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, সে সমাজে মাথা উঁচু করে চলার ক্ষমতাও হারিয়েছে। এতেও কি তার যথাযথ শাস্তি হয়নি?

হাতছানি দিয়ে ডাকেন তাপ্তী। রুবি এগোতে পারে না। পা যেন মাটিতে শক্ত করে আটকে গেছে। কাছে এসে গায়ে হাত রাখেন তাপ্তী।

“আয় রুবি। এতগুলো বছর ধরে তোর ফেরার অপেক্ষায় দিন গুণছি।”

চোখ নামিয়ে নেয় রুবি, “বিশ্বাস করো কাকিমা, সেদিন আমার কাছে কোন উপায় ছিল না। বাধ্য হয়েই আমি …”

“আমি জানি।”

তাপ্তীর শান্তস্বরে ভীষণ অবাক হয় রুবি।

“অবাক হচ্ছিস? অনেক কিছু জেনেও আমি চুপ থাকতে বাধ্য ছিলাম। আজ তোর কাছে এসেছি ক্ষমা চাইতে।” তাপ্তী বলেন।

“ক্ষমা! কী বলছ কাকিমা? আমি, আমি …” রুবি বিস্ময়ে ফেটে পড়ে।

“এখানে আর কথা নয়। সামনে আমার গাড়ি আছে। যা বলার গাড়িতে বসে বলবি।”

তাপ্তীকে অনুসরণ করে রুবি।

“বল কী বলতে চাস?” গাড়িতে বসে তাপ্তী বলেন।

“সেদিন কাকু আমায় ডেকেছিল। চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে বলে। পাড়ারই মন্তেসরি স্কুলে। কাকু এটাও বলেছিল, ওঁর চিঠি নিয়ে কর্তৃপক্ষকে দেখালে চাকরিটাও হবে আর মাইনেটা অন্যদের থেকে বেশি পাব। কিন্তু সেদিন কাকু আমার সর্বনাশ করবে ভাবতেও পারিনি। রাগে ক্ষোভে টেবিল ল্যাম্পটা কাকুর মাথায় মেরে দিয়েছিলাম। আর তারপর তো…” রুবি হাঁফাতে থাকে।

“বেশ করেছিস। তুই সেদিন ওই কাজটা না করলে আমাকে করতে হত।” ঘৃণা উপছে পড়ে তাপ্তীর কণ্ঠে।

“কাকিমা!”

“ঠিক বলছি। দীপক তার পদের জোরে অনেক মেয়ের সর্বনাশ করে আসছিল বহুদিন ধরে। গরীব বাবার মেয়ে আমি। অন্যায় দেখেও সহ্য করতে হচ্ছিল শুধুমাত্র আমার পঙ্গু ভাইটার জন্য। তার চিকিৎসার সব খরচ দীপক দিত। ভাই চলে যাবার পরেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, আর দীপকের কোনও অন্যায় মেনে নেব না। আমি কিছু করার আগেই তুই …”

“ক্ষমা করে দিও কাকিমা।”

“ক্ষমা কীসের? আজ আমি তোর কাছে ক্ষমা চাইছি। তোর জীবনের বারোটা বছর নষ্ট হয়ে গেল। এই দিনগুলো তোকে ফেরত দিতে পারব না। তবে বাকি দিনগুলো যাতে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারিস তার ব্যবস্থা করেছি। এই নে টিকিট। আর এই ব্যাগে জামাকাপড় আছে। আজ রাতের ট্রেন। দেরাদুনের একটা বোর্ডিং স্কুলের সুপার হয়ে যাবি তুই।”

রুবির বিস্ময়ে কথা সরে না।

“হাঁ করে কী দেখছিস? দীপক তার পদ, ক্ষমতার জোরে দিনের পর দিন অন্যায় করে গেছে। আজ দীপকের জায়গায় পদ, ক্ষমতা আমার হাতে এসেছে। দীপকের সমস্ত অন্যায়ের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায় আমার। এবার আমি একটা গ্লানি থেকে মুক্ত।”

“এবার ক্ষমতার সদ্‌ব্যবহার, তাই না কাকিমা?” রুবি জড়িয়ে ধরে তাপ্তীকে।

অনেকগুলো বছর পর দুই রমণীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

3 thoughts on “micro-story-khomota

Leave a Reply to Rakhi Addy Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *