short-story-ekti-nikhut-hotya

একটি নিখুঁত হত্যার চিত্রনাট্য
রেহান কৌশিক


প্রাচীন কৃষ্ণচূড়া। যদিও তিনটে মাত্র ডাল। পাতা ও ফুলে ভরা। হাওয়া লেগে মাঝে-মাঝে লালহলুদ পাপড়ি খসে পড়ছে। আশেপাশে আর কোনো গাছ নেই। বোঝা যাচ্ছে নতুন হাইওয়ে হওয়ার সময় কাটা পড়েছে। এই গাছটা কেন রক্ষা পেল, সেটাই আশ্চর্যের। গাছটার তলায় ছোট্টো চায়ের দোকান। সামনে বাঁশ দিয়ে বানানো বেঞ্চ। ফাঁকা। এখন দুপুর বলেই বোধহয় কেউ কোথাও নেই। চারপাশ শুনশান।

এমন একটা জায়গায় এসে নিজেকে বোকা-বোকা লাগছে। এমনিতে যথেষ্ট সাবধানী। হুটহাট কোনো কমিট করে না। কথা দেওয়ার আগে সাতবার ভাবে। কিন্তু এক্ষেত্রে কী যে হল!

ইনফ্যাক্ট, এটা তার ডিগনিটিকেও জাস্টিফাই করছে না। ইউজ্যুয়ালি, কোনও ক্লাবে বসে আলোচনাটা হতে পারত। নিদেনপক্ষে, সিসিডি। এখন নিজেই অবাক হচ্ছে, শহর ছাড়িয়ে হাইওয়ের পাশে এই মামুলি জায়গায় আসতে কেন রাজি হল? রুহানির মতো অসামান্য সুন্দরীর মার্জিত ও মিষ্টি টোনাল কোয়ালিটির জন্য?

অসামান্য সুন্দরী? নিজের মনেই হেসে উঠল একবার। রুহানি সুন্দরী না অসুন্দরী জানল কী করে? সামনাসামনি তো দেখা হয়নি। আজই ফার্স্ট মিটিং। মোবাইলে গলা শুনে সুন্দর-অসুন্দর বোঝা যায়? যায়, যায়।

নিজের সঙ্গে নিজেই বকবক করতে করতে বামহাতের কবজির দিকে তাকাল। পৌঁনে একটা। বাঙালির কথা না বলাই ভালো। আধঘণ্টা লেটটাই রাইট টাইম। বিদেশী কালচারে পাংচ্যুয়ালিটি একটা ব্যাপার। রুহানি আশা করি ঠিক সময়েই আসবে। দেখা যাক। আর পাঁচমিনিট বাকি।

হলও তাই। শার্প বারোটা পঞ্চাশ। কালো স্করপিও গাড়িটা মসৃণভাবে গতি কমিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গেল। দরজা খুলে নেমে এল রুহানি। ফেডেড ব্লু জিনস। মেরুন টি শার্ট। মাথায় হর্সটেল। চোখে রে-ব্যানের সানগ্লাস। তাতে নীলচে আভা। নির্মেদ চেহারা। যেন নামী কোনো যোগা-সেন্টারের বিজ্ঞাপনী মডেল।
গাড়ি থেকে নেমেই মিষ্টি হাসল।
কাছে এসে বলল, “খুব বেয়াড়া আবদার করেছি শিরিষ?”
“তা, না। আসলে আমরা তো শহরের মধ্যেই…”
“বসতে পারতাম, রাইট? কিন্তু এখানে এলাম কেন, তাই তো?”
শিরিষের ঠোঁটে শুকনো সৌজন্যের হাসি। রুহানি বলল, “আমার মনে হয় খুনের চিত্রনাট্য নির্জনতায় লেখা ভালো। নির্জনতা মনকে শান্ত করে। মস্তিষ্ককে শানিত করে। আর, খুনের প্ল্যানকে ফুলপ্রুফ করতে হলে এমন একটা মন ও মস্তিষ্ক জরুরি।”
“কিন্তু আমরা তো আর খুনি নই। একটা হত্যার চিত্রনাট্য নিয়ে কথা বলব।”
“রাইট। বাট, গল্পটা বানানোর সময় তোমাকে একজন খুনির রোলই প্লে করতে হবে। ভাবতে হবে খুন হচ্ছে একটা আর্ট, শিল্প। এই শিল্পের উপাদান কী? প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্ক আর প্রগাঢ় বাস্তব জ্ঞান। জানবে, খুনির মাথা যত ঠান্ডা হবে, পরিকল্পনা হবে তত নিখুঁত, তত নিশ্ছিদ্র।”
“ওকে। আমরা স্ক্রিপ্টে যে-ক্রাইমটার কথা বলব, সেটা থাকবে আনসলভড, তাই তো?”
“একটা পয়েন্ট ড্রপ করে গেলে।”
“কী?”
“ক্রাইমটা কোনও পুরুষ নয়, মহিলা করবে।”
“হ্যাঁ। ফোনে বলেছিলে। কিন্তু খুব অবাক লাগছে, স্ক্রিপ্টের শর্তগুলো দেখে। একটা খুন হবে…”
“একটা কেন, একের বেশিও হতে পারে।”
“এনিওয়ে, মার্ডার প্ল্যানিংটা করবে একজন মহিলা। খুনটা এত নিখুঁত হবে যে সেটা আনসলভড থেকে যাবে।”
“অন্তত আইনের চোখে। ভাবতে পারো এটা একটা খুন খুন খেলা। মজার ব্যাপার হল যে খুন হচ্ছে, যে খুন করছে সবই স্পষ্ট কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তাকে ধরা যাচ্ছে না। আইনের চোখে কেসটা আনসলভ হয়ে ধুলোমাখা ফাইলের ভিতর বন্দি থাকছে।”
“অনেক চিত্রনাট্য করেছি, কিন্তু এতরকম শর্ত কেউ আরোপ করেনি।”
“কী করব, বলো। ইট’স অল ডিরেকটর’স চয়েস।”
“প্রজেক্টটা একটু ডিটেইলস করবে, প্লিজ।”
“শিওর। হলিউডি ডিরেক্টর মার্ক আর্চারের কথা আগেই বলেছি। এটাও বলেছি উনি এশিয়ান দেশগুলোর ক্রাইম প্যাটার্নের ওপর দশটি শর্টফিল্ম বানাতে চান। আগে বলেছি, আবারও বলছি গল্পের শর্ত মূলত দুটো। এক, ক্রাইমের মাস্টারমাইন্ড হবে একজন উয়োম্যান। সেকেন্ড, ক্রাইমটা আনসলভড থাকবে। গল্পের স্ক্রিনটাইম তিরিশ মিনিট। যেহেতু আমি নিজে বাঙালি এবং তুমি খুব ভালো স্টোরি ও স্ক্রিপ্ট করো, তাই তোমাকে কাজটা দিতে চাইছি। বাই দ্য ওয়ে, এই স্টোরি ও স্ক্রিপ্টটার জন্য রেমুনারেশন তিন লাখ। যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। আশা করি, পছন্দ হবে।”

“অনেস্টলি স্পিকিং, এতটা আশা করিনি।”
“গুড। গল্পটা ভেবে এসেছ?”

ভয়ঙ্কর বিস্বাদ চা। ব্ল্যাক টি। অবাঙালি বুড়ো চাওয়ালা আদা থেঁতো করে মিশিয়েছে। অতি জঘন্য চায়ে চুমুক দিয়ে শিরিষের মুখ চোখ কুঁচকে গেল। রুহানির কোনো ভাবান্তর নেই। চা শেষ করে বুড়োর হাতে কুড়ি টাকার নোট দিয়ে রুহানি বলল, “সির্ফ আদ্রক কিঁউ, অর ভি কুচ সবজি ডাল দিজিয়ে, অর ভি সাদিষ্ট হোগা।”

বুড়ো ঠিক বুঝতে পারল না রুহানি তার প্রশংসা করল না নিন্দা।
মুখে হাসি ফুটল শিরিষের। মজা করে বলল, “গ্রামের দিকে সবজির দাম কম, বুড়ো হয়তো সত্যিই এবার সবজি-চা বানাতে শুরু করবে।”
হাইওয়ের পাশে ফসলের ক্ষেত। উচ্ছে, পটল, লাউয়ের মাচা। মাচা থেকে লাউ ঝুলছে। কিছু ক্ষেতে সবুজ শাক। ক্ষেতের মাঝে লোহার খাঁচায় ইলেকট্রিকের হাইটেনশন লাইন। কয়েকটা ফিঙে সেই তারে বসে দোল খাচ্ছে।
রুহানি মুখ ফেরাল। শিরিষের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, “এগোই?”
শিরিষ মনে মনে ভাবল বিদেশে থাকার ফল। সময়ের কাজ সময়ে করতে এদের ভুল হয় না। মুখে বলল, “মহিলাটি পুলিশ অফিসার। স্বাভাবিকভাবেই ক্রিমিন্যাল সাইকোলজি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। অবিবাহিত। বয়স্ক বাবা-মা ও এক ভাই। ভাই কিছু করে না। বখাটে। একার উপার্জনে পরিবার চলে। চাকরিক্ষেত্রে অসৎ আয়ের হাতছানি। চোখের সামনে দেখে তার সিনিয়র অফিসাররা করাপ্টেড। সে করাপশনে শামিল হচ্ছে না বলে প্রতিক্ষেত্রে লাঞ্ছিত হচ্ছে। ঠিক এমন সময়…।”
“শিরিষ, লিসন। একটু ইন্টারাপ্ট করছি। স্টোরিলাইনটা কি আমরা একটু অন্যভাবে ভাবতে পারি?”
শিরিষ ক্ষণিকের জন্য থমকে যায়। তারপর বলে, “গল্পটা ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে না?”
“যে কোনও ঘটনাকেই ইন্টারেস্টিং করে তোলা যায়, ইট ডিপেন্ডস অন হাউ টু ফ্রেম ইয়োর ন্যারেশন। আমার মনে হল আমরা যদি একটু অন্যভাবে ভাবি…”
“কীরকম?”
“দেখো, আমি জাস্ট হিন্ট দিচ্ছি। বাট, স্টোরি অ্যান্ড ডায়লগস তুমিই লিখবে। অবভিয়াসলি, যদি তোমার পছন্দ হয়, তবেই।”
মুখ চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে শিরিষ একটু বিমর্ষ হল। রুহানি বলল, “তোমার যদি আপত্তি থাকে, তাহলে থাক। ভেবো না, তোমার ক্রেডিটে ভাগ বসাতে চাইছি।”
শিরিষ বুঝল তার অ্যাটিটিউড থেকে রুহানি কিছু একটা ফিল করেছে। অপ্রস্তুত হয়ে শিরিষ বলল, “কী যে বলো! তোমার ভাবনাটা শেয়ার করো, প্লিজ।”
“ওকে। একটা মফঃস্বল শহর। সেখানে একটা প্রাইভেট হসপিটাল। যার মালিক এক ইনফ্লুয়েনসিয়াল পলিটিক্যাল লিডার। ধরো, তার নাম সূর্যকুমার। সেখানে একজন লেডি ডক্টর সর্বেসর্বা, কী নাম দেওয়া যায় বলো তো? নাম দিয়ে ক্যারেকটারগুলো আলাদা করলে বুঝতে সুবিধে হবে।”
শিরিষ বলল, “নূপুর।”
“একটা সারনেম দাও।”
“সেন।”
“ওকে ফাইন, নূপুর সেন। হাসপাতালে নানান ইললিগ্যাল কাজ হত। লাইক আলট্রাসোনোগ্রাফি করে প্রিসেক্স-ডিটেকশন, কন্যা ভ্রূণ হত্যা। কিংবা ধরো, অরগ্যান ট্রাফিকিং, এটসেটরা। ডাক্তার নূপুর সেন ছিল এইসব দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড।”
“বেশ। তারপর?”
“জলের স্রোতের মতো টাকা আসছে। সূর্যকুমার খুশি। ইনফ্যাক্ট, সূর্যকুমার খুশি দুটো কারণে। এক, টাকা। দুই হল নূপুরের সঙ্গে অ্যাফেয়ার। নূপুর ঘটনাচক্রে কনসিভ করে।”
“যে নিজে ডাক্তার সে ইলিলিগ্যাল অ্যাফেয়ার থেকে কনসিভ করবে? এটা কোনও যুক্তি হল?”
“আহ, পেসেন্স রাখো। একটু শোনো, প্লিজ…”
“স্যরি, স্যরি। ক্যারি অন।”
“নূপুরের প্রেগনেন্সিটা সূর্যকুমারের কাছে খুব এমব্যারেসিং। কিন্তু নূপুর অ্যাবরশন করাতে রাজি হল না। কারণ, তার হাজব্যান্ড সুতনু সন্তানের জন্মদানে অক্ষম। স্পার্মকাউন্ট ভেরি পুয়োর। সে মেডিসিন নিচ্ছে, কিন্তু ভরসা নেই। তাই নূপুর জেনেবুঝেই অ্যাবরশন করাল না।”
“তাহলে লজিকটা ঠিক।”
“হাসপাতালে জয়েন করেছে নতুন ডাক্তার অসীম মুখোপাধ্যায়। কয়েকদিনের মধ্যেই হাসপাতালের দুর্নীতি স্পষ্ট হল। সে নূপুরকে সৎ পথে ফেরার জন্য রিকোয়েস্ট করল। কিন্তু তার চেষ্টা বিফল হল। ডাক্তার অসীম মুখোপাধ্যায় রেজিগনেশন দিল। হাসপাতাল ছেড়ে দিল। তারপর নূপুরকে আরও একবার সৎ পথে ফেরানোর জন্য নূপুরের স্বামী সুতনুর সঙ্গে কথা বলল। এর ফল হল উলটো। নূপুর ও সুতনুর শুধু কথা কাটাকাটি হল তাই নয়, ঝগড়ার মাথায় সুতনু জানল যে তাদের সন্তান অনির্বাণের বায়োলজিক্যাল ফাদার সে নয়। কলেজের অধ্যাপক সুতনু নরম মনের মানুষ। একসময় গভীর ডিপ্রেশনে চলে গেল। অন্যদিকে নূপুর আরও বেপরোয়া হয়ে উঠল। সূর্যকুমারের মদতে ডাক্তার অসীম মুখোপাধ্যায়কে হুমকি দিল। মুখ খুললে খুন করা হবে।

অসীম ভিতু নয়। সে ধমককে পাত্তা দিল না।”
শিরিষ হঠাৎ প্রশ্ন করল, “ডাক্তার অসীম কোন লজিকে সুতনুবাবুকে নূপুরের কথা জানাল?”
“ভ্যালিড পয়েন্ট। অ্যাকচ্যুয়ালি, নূপুরের হাজব্যান্ড সুতনু হল অসীমের স্কুলমেট। সেই সূত্রে বলেছিল। ক্লিয়ার?”
“ক্লিয়ার। দেন?”
“হাসপাতালের দুর্নীতি ক্রমাগত বেড়ে চলল। অসীম আর চুপ থাকল না। ঠিক করল ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনকে জানাবে। কী করে যেন খবরটা পেয়ে গেল নূপুর। নিখোঁজ হয়ে গেল ডাক্তার অসীম মুখোপাধ্যায়। তিনদিন পরে তার লাশ পাওয়া গেল। পুলিশ সেই খুনের কিনারা করতে পারল না।
এখন প্রশ্ন, পারল না, নাকি করতে দেওয়া হল না? তা অজানাই থেকে গেল।”
“ভেরি ইন্টারেস্টিং। দেন?”
“বন্ধুর মৃত্যু আরও ভেঙে দিল সুতনুকে। সে বুঝতে পারল এই হত্যার পিছনে কে। কিন্তু মুখ খুলতে পারল না। আরও ডিপ্রেসড হয়ে গেল। কয়েকদিন পর আত্মহত্যা করল। সুইসাইড নোটে তার মৃত্যুর জন্য কাউকেই দায়ী করে যায়নি।”
“ঘটনাটা এমনিতে ইন্টারেস্টিং। নানা সম্পর্কের টানাপোড়েন আছে। সেক্স আছে। ভায়োলেন্স আছে। কিন্তু খুব কি নতুন কিছু?” বলল শিরিষ।
রুহানি বলল, “আমার কথা শেষ হয়নি।”
“আয়াম এক্সট্রিমলি স্যরি রুহানি। প্লিজ, কনটিনিউ…”
“ডাক্তার অসীমের মৃত্যুর পর তার মেয়ে এবং বউ কানাডায় চলে গেল। রিলেটিভের কাছে। এরপর পেরিয়ে গেল বাইশ বছর। এই বাইশ বছরে অসীমের ছোট্ট পাঁচবছরের মেয়ে একদিনের জন্যও বাবার মুখ ভুলতে পারেনি। ইনফ্যাক্ট, ভুলতে চায়ওনি। সে কানাডায় পুলিশ অফিসার হয়েছে। সে দেশে ফিরে এসেছে। নূপুরকে হত্যা করবে বলে।”
“মাই গড! একজন পুলিশ অফিসার আইন হাতে তুলে নেবে?”
“না। সে নিজে কিছুই করবে না। হত্যা করাবে। প্রতিশোধ নেবে।”
“কিন্তু সে তো আইনের আশ্রয় নিয়ে অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারত।”
“এত সময় তার নেই। দ্বিতীয়ত, সে এখানে প্রমাণ সংগ্রহ করবে কী করে? কে তাকে সাহায্য করবে? অথচ, বাবার খুনিকে শাস্তি না দিলে তার মন শান্ত হবে না। দীর্ঘ বাইশ বছর সে গভীর যন্ত্রণা বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে।
সে জানতে পারে বর্তমানে সূর্যকুমারের সঙ্গে নূপুরের সম্পর্ক নেই। হাসপাতাল থেকে নূপুরকে তাড়িয়ে দিয়েছে সূর্যকুমার। এটা জানতে পেরে সে একটা প্ল্যান করে। বিদেশ থেকে তার বন্ধুদের ফেক মোবাইলের ফেক নাম্বার থেকে ক্রমাগত সূর্যকুমারকে ফোন করায়। জানায় নূপুর অনির্বাণের পিতৃত্ব দাবি করবে বলে প্রস্তুত হচ্ছে। সূর্যকুমারের পলিটিক্যাল কেরিয়ার এখন তুঙ্গে। সে রাজ্যের ট্রান্সপোর্ট মিনিস্টার। তার প্রভাব, প্রতিপত্তি, সম্মান এখন আকাশছোঁয়া। শেষ পর্যন্ত সূর্যকুমার চব্বিশ ঘণ্টার আলটিমেটাম পায়। হয় নিজে প্রেস ডেকে অনির্বাণকে নিজের পুত্র বলে স্বীকার করো, নাহলে প্রেস ডেকে সেই কাজ করবে নূপুর। সূর্যকুমার বুঝতে পারে ডিএনএ টেস্ট করলে সে ফেঁসে যাবে। একমুহূর্তে তার পলিটিক্যাল কেরিয়ার মাটিতে মিশে যাবে। এমন কী জেলও অনিবার্য। প্রেসের কাছে কনফেস করার চেয়ে নূপুরকে নিকেশ করা তার কাছে অনেক সহজ। সে এই পথটাই বেছে নেয়। এবং কার্যত হলও তাই। নূপুর খুন হল।”

একটানা কথা বলে রুহানি এবার থামে। বুড়োর কাছে চা নিয়ে চুমুক দেয়। শিরিষ বলল, “প্রকৃত তদন্ত হলে সূর্যকুমার তো ধরাও পড়তে পারে। তাহলে ক্রাইমটা আনসলভড থাকল কী করে?”
“সূর্যকুমার কি এখানে সত্যিকারের খুনি?”
চমকে গেল শিরিষ। বলল, “তাই তো!”
হাসল রুহিতা। বলল, “সূর্যকুমার দাবার বোড়ে। গ্র্যান্ডমাস্টার কানাডায়।”
“এক্সেলেন্ট! বাইশ বছর আগের পর্ব কুড়ি মিনিট, আর পরের পর্ব দশ মিনিট। টাইট স্ক্রিপ্ট করলে থ্রিলারটা দাঁড়িয়ে যাবে।”
“বলছ?”
“হান্ড্রেড পারসেন্ট। তুমি আমার ওপর রিলাই করতে পার।”
“গুড। তাহলে স্ক্রিপ্টটা কবে পাব?”
“দু’দিন সময় দাও।”
দুপুর গড়িয়ে গেছে। বিকেলের সূর্য লালবলের মতো ধূ-ধূ ফাঁকা নির্জন মাঠে গড়াচ্ছে। মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা লালচে হলুদ রোদে কেমন যেন মনখারাপের ঘোর। সেদিকে তাকিয়ে রুহানি বলল, “বেস্ট অফ লাক। রেডি হলেই জানিও। চলো, লেটস গো।”
“তুমি কি শহরের দিকে যাবে?” জিজ্ঞেস করল শিরিষ।
“না। কেন?”
“সিসিডিতে কফি নিয়ে কিছুক্ষণ বসতাম। মাথা জ্যাম হয়ে আছে।”
“আমি শহরের দিক থেকে আসিনি। সামনে কিছু দূরে যে রাস্তা গ্রামের ভিতর বেঁকে গেছে, ওটা দিয়ে এসেছি, আবার ওটা দিয়েই ফিরব। অন্য কাজ আছে।”
“নো ইস্যু।” শিরিষ উবের বুক করে দিল।

রুহানি গাড়ি স্টার্ট করে বেরিয়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে শিরিষ মনে মনে হাসল। ভাবল এরা কী হার্ডকোর প্রফেশনাল! কাজের বাইরে একটাও বাড়তি কথা নেই। তবে রুহানিকে থ্যাংকস জানাতে ও ভুলল না। কী সুন্দর করে গল্পটা বেঁধে দিল। অথচ, এক মুহূর্তের জন্যও মনে হল না সে এর জন্য কোনও কৃতজ্ঞতা আশা করছে।

উবের এসে গেছে। শিরিষ উঠে গেল। কিছুক্ষণ পরেই একটা ফোন এল। নাম্বার দেখেই বুঝল ইন্টারন্যাশনাল কল। রিসিভ করল শিরিষ। ফোনের ওপ্রান্তে সরু মেয়েলি গলা, “আমি কি মিস্টার শিরিষ সরকারের সঙ্গে কথা বলছি?”
“হ্যাঁ। আপনি?”
“প্রথমেই কনগ্রাচুলেশন। আমাদের প্রজেক্ট অ্যাকসেপ্ট করার জন্য।”
“থ্যাংকস। হ্যাঁ, জাস্ট রুহানির সঙ্গে মিটিং হয়েছে।”
ওপ্রান্ত থেকে খিলখিল করে একটা হাসির আওয়াজ হল। থমকে গেল শিরিষ। বলল, “আপনি কে বলছেন, জানতে পারি?”
“রুহানি।”
“হোয়াট! এটা রুহানির ভয়েস নয়। কে আপনি?”
আবার হাসির আওয়াজ। শিরিষ বিভ্রান্ত।
কণ্ঠস্বর রূঢ় হয়ে উঠল, “আপনি কি আমার সঙ্গে মজা করছেন?”
“সার্টেনলি নট।”
“তাহলে কিছুক্ষণ আগে যে মিটিং করে গেল তার নাম কী?”
“রুহানির ডামি।”
“ডামি! কীসব ফালতু কথা বলছেন?”
“আপনি এত চেনা মানুষ, আপনার সঙ্গে ফালতু কথা বলব কেন?”
“আমি আপনার চেনা?”
“অফকোর্স। শুনুন, আমার ডামি, আই মিন ডামি-রুহানি, কয়েকটা নাম ভুল বলেছে। স্ক্রিপ্ট করার সময় পাল্টে নেবেন, প্লিজ।”
এসির ভিতর শিরিষের রীতিমতো অস্বস্তি হচ্ছে। এমন অদ্ভুত ও রহস্যময় কোনও মেয়ের সঙ্গে ইতিপূর্বে কখনও কথা হয়নি। সিক্সথ-সেন্স বলছে, সে খারাপ কিছুর মধ্যে জড়িয়ে পড়ছে। তবু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল, “গল্পে বাইশ বছরের আগে-পরে দুটো পর্ব। স্বাভাবিকভাবেই সময় অনুয়ায়ী স্ক্রিপ্টে নামের বদল হবে।”
“আপনি বুদ্ধিমান। তবে আমি যে নামগুলো বলব, সেগুলোই ব্যবহার করবেন।”
“কেন মজা করছেন বলুন তো?”
“মজা করছি না। সত্যি ঘটনার নামবদল করলে গল্পটাও মিথ্যের মতো মনে হবে। আমি চাই না, তা হোক।”
“সত্যি ঘটনা?”
“হ্যাঁ। সূর্যকুমার নয়, ওই পলিটিক্যাল লিডারের নাম দেবেন রণজয় সিংহ।”
“স্ট্রেঞ্জ! উনি তো ট্রান্সপোর্ট মিনিস্টার।”
“লেডি ডাক্তারের নাম নূপুর সেন নয়। মহাশ্বেতা। মহাশ্বেতা সরকার।”
“হোয়াট? এ তো আমার মায়ের নাম।”
“ডোন্ট বি এক্সাইটেড। আত্মহত্যা করা তার হাজব্যান্ডের নাম…”
থরথর করে কাঁপছে শিরিষ। কোনওরকমে বলল, “সায়ন্তন সরকার?”
খিলখিল করে হাসির আওয়াজ উঠল। অন্যপ্রান্তের মেয়েটা বলল, “ব্রিলিয়ান্ট!”
শিরিষের শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। কেঁপে উঠল গলা, “এক্ষুনি পুলিশে কমপ্লেন করব।”
মেয়েটি এবার হাহা করে হেসে উঠল। বলল, “স্বচ্ছন্দে। তা গিয়ে কী বলবেন?”
“রুহানির সেল নাম্বার আমার কাছে আছে। যে ব্ল্যাক স্করপিয়ো গাড়িতে এসেছিল তার নাম্বার…”
“ফেক। গাড়ির নাম্বার ফেক। মোবাইল নাম্বার ফেক। মোবাইল সেট ফেক। ইভন আপনি তার যে চেহারা দেখেছেন, সেটাও ফেক। আপনাকে যে ফাইল দিয়েছে, তার ওপর কোনও ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাবেন না। হাতে সূক্ষ্ম গ্লাভস ছিল। মোবাইল নাম্বার ধরে পুলিশ কোনও লোকেশন ট্রাক করতে পারবে না, কারণ সে সমস্ত কল করেছে রাস্তা থেকে। এবং প্রত্যেকবার কলের পর ওখানেই সুইচড অফ করে দিয়েছে। যান, হিম্মত থাকলে পুলিশের কাছে গিয়ে বলুন আমার মা মহাশ্বেতা সরকার হাসপাতালে ইললিগ্যাল অ্যাবরশন করত। বেআইনিভাবে সেক্স ডিটেক্ট করত। বলুন, সায়ন্তন সরকার নয়, আমি রণজয় সিংহের সন্তান। বলুন সায়ন্তন সরকার মরতে চায়নি, তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে। তারপর বলুন বাইশ বছর আগে ডাক্তার জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের যে লাশটা উদ্ধার হয়েছিল শহরের বাইরে রাস্তার পাশে, কৃষ্ণচূড়াগাছের তলায়, তার খুনি আর কেউ নয়, আমার মা ডাক্তার মহাশ্বেতা সরকার। যান, সাহস থাকলে এক্ষুনি পুলিশের কাছে গিয়ে কনফেস করুন।”

“প্লিজ, স্টপ ইট।”
ফোন কেটে দু’হাতে নিজের মাথা চেপে ধরল শিরিষ। পরমুহূর্তে ফোন করল মাকে। রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ করছে না। পাগলের মতো বারবার রিং করছে। নাহ, তুলছে না।
কয়েক মিনিটের মধ্যে কে যেন তার এতদিনের সমস্ত বিশ্বাস, সমস্ত সম্পর্কের পৃষ্ঠাগুলোকে ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিল। যার একটা টুকরোও সে হাত বাড়িয়ে আর ছুঁতে পারছে না।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “short-story-ekti-nikhut-hotya

  1. কি অসাধারণ একটা রহস্য কাহিনী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *