short-story-poribortito-poristhithi

পরিবর্তিত পরিস্থিতি
বিপুল দাস


চিৎকার শুনে ঋক ক্রাচটা নেবার সময় পেল না। এক পায়েই লাফাতে লাফাতে এ ঘরে এলো। দেখল, ছোটবড় মিলিয়ে দশবারোটা আরশোলা ফরফর করে উড়ে বেড়াচ্ছে। সংহিতা আঁচল দিয়ে পুরো মাথা ঢেকে মৃতবৎ বিছানায় শুয়ে আছে। যেন আরশোলা মরামানুষ ছোঁয় না।

রাগতে গিয়েও ঋক হেসে ফেলল। বেশির ভাগ মেয়েদের মত সংহিতাও আরশোলা ভীষণ ভয় পায়। অথচ ঋকের মাথায় কিছুতেই ঢোকে না আরশোলায় ভয়ের কোন জিনিসটা আছে। কী সুন্দর একজোড়া রেশম-মসৃণ খয়েরি ডানা। এক জোড়া শুঁড় এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে খোঁজখবর নিচ্ছে খাবারদাবার, বিপদআপদ, তাপমাত্রা ও বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ। ঋকের মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অ্যান্টেনা ওই শুঁড়দুটো। আবহমণ্ডলে বিপদজনক যে কোনও তরঙ্গমালা নির্ভুলভাবে ধরে ফেলে ওই অ্যান্টেনা। বাতাসে বারুদের ঘ্রাণ বড় তাড়াতাড়ি বুঝতে পারে হারামজাদারা। ফলত পেরিপ্লানেটা আমেরিকানা নামক এই পতঙ্গ অবিকল রয়ে গেল হাজার হাজার বছর ধরে। শালারা পদ্মানদীর মাঝির স্পাইন খায়, ল্যাক্টোজেন খায়, দামি দার্জিলিং টি নষ্ট করে, হারমোনিয়ামে বাসা বাঁধে। পঁচিশে বৈশাখে যখন ঋক নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সংহিতাকে বলে সেই গানটা করতে, তখন সংহিতা হারমোনিয়ামের বাক্স খুলতেই ফরফর করে ওরা যুদ্ধ-বিমানের মত ছড়িয়ে পড়েছিল। ভয়ে সংহিতা আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে মড়ার মত শুয়ে পড়েছিল। আরশোলা সব চেটে খায়। পোটাটো ইটার্স, সচিত্র কোকশাস্ত্র, লু সুন, টোডরমলের ভূমি সংস্কার। পরিবর্তনের সূক্ষ্ম ইশারা শুঁড়ে টের পায়। খোলস পালটায়। লোকে বলে প্রগতিশীল।

প্রথম আলাপে খুব লজ্জায় পড়েছিল ঋক। জীবনে এই প্রথম বারের জন্য নিজের নাম বলতে সে ইতস্তত করছিল। সংহিতা এবং ঋক – এই নামদুটোর মধ্যে নৈকট্য বড় বেশি। ঋকের ভয় হচ্ছিল সংহিতা যদি ভেবে বসে ঋক বানিয়ে বলেছে। কিন্তু ঋক তো ঋকই। নাচার হয়ে সে নিজের নাম বলেছিল। খুব সূক্ষ্ম একটু হাসির রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গিয়েছিল সংহিতার ঠোঁটের আড়ালে। নেহাত ঋক ওর দিকে অপলকে তাকিয়েছিল বলেই ধরতে পেরেছিল। গদগদ, প্রেমে মাখোমাখো হয়ে নয়, ভয়ে ভয়েই সংহিতার দিকে তাকিয়ে ছিল ঋক। ওর নাম শোনার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া হিসেবে সংহিতার মুখ দেখবে বলেই তাকিয়েছিল। অথচ সংহিতা কত সপ্রতিভ। দু’হাত বুকের কাছে জড়ো করে স্পষ্ট উচ্চারণে বলল – সংহিতা গঙ্গোপাধ্যায়।

ঋক খুব ভালো করেই জানে ইদানীং যে সব নবীন আবৃত্তিকার নাম করেছে – তাদের মধ্যে সংহিতা অন্যতম। ঋকদের যুব সংগঠনের দক্ষিণ কলকাতা সম্মেলনের প্রথম দিন যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল, সেখানে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুই ছিল সংহিতা গঙ্গোপাধ্যায়ের আবৃত্তি। ওভাল শেপের চশমার আড়ালে দু’টো ঝকঝকে চোখ। তাঁতের শাড়ি। উদাত্ত ও অনুদাত্তে, কখনও মন্দ্র, কখনও নিচু স্বরে, নির্লিপ্ত ও ক্রোধী অভিব্যক্তি শুধু উচ্চারণে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর শঙ্খ ঘোষ ছাড়া আর কারও কবিতা আবৃত্তি করে না সে।

ঋকের প্রথম কবিতার বই তখন সদ্য বেরিয়েছে। বই-এর নাম সংকলনের অন্তর্গত ‘ফিনিক্সের গান’ কবিতাটির নাম দিয়েই। ঋক তখন সংগঠনের সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের জবরদস্ত কর্মী। কট্টর বিশুদ্ধবাদীরা তার কিছু কবিতার কঠোর সমালোচনা করেছিল। নরম নরম শব্দগুলো বাদ দিতে হবে। শাণিত ক্ষাত্রতেজে আক্রমণ করতে হবে দুনিয়ার সব প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে। ও সব ভাববাদী কলা-কৈবল্যবাদ লড়াইয়ের ময়দানে চলে না।

উঠতি কবি ঋক সেনগুপ্ত খুব আতান্তরে পড়ে যায়। এরা কোন লড়াই-এর ময়দানের কথা বলছে। যেখানে এখন জুনিয়ার পিসি সরকার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হাপিশ করার খেলা দেখায়? কোন লড়াই? সময়কে উথালপাথাল করে দেওয়া জঙ্গী অনীকিনী এখন ছত্রিশটা ফ্রন্টে ভাগ হয়ে ঝগড়া করে চলেছে। ঋক ঠিক বুঝতে পারে না নরম শব্দ বলতে এখানে ওরা ঠিক কী বোঝাতে চাইছে। প্রচলিত উপমায় চাঁদ ভারি নরম শব্দ, কিন্তু সঠিক প্রেক্ষাপটের সঠিক ব্যবহারে সে কি শাণিত কাস্তের মত ব্যবহৃত হয়নি। ‘মিছিলে তোমার উদ্ধত হাত গোলাপের চেয়ে সুন্দর/স্লোগানে তোমার রক্তিমা যেন ঝরে’। এই দুটো লাইন নিয়ে তাকে তুলোধোনা করে দিয়েছিল তাদের জেলা কমিটির নেতা কমল আচার্য। সমস্ত রাজ্যজুড়ে এবং রাজ্যের বাইরেও দলের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান পুরুষ কমলদার জ্ঞান প্রশ্নাতীত। সুগভীর পাণ্ডিত্য এবং জটিল তত্ত্বকে সহজ করে বুঝিয়ে বলার ক্ষমতা লোকটাকে পার্টির বুদ্ধিজীবী মহলে অসম্ভব জনপ্রিয় করে তুলেছে। কমল আচার্যকে ভেতর থেকেই শ্রদ্ধা করে ঋক। তবু তার মনের ভেতরে কোথাও একটা কাঁপন ধরে।

‘সুন্দর জিনিসের তুলনা দিতে হলে গোলাপকেই কেন টেনে আনতে হবে?’ কমলদা বলেছিল। অন্যরা বলুক, আপনি কেন বলবেন। আপনার দর্শন বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। বেচারা গোলাপ, যুগ যুগ ধরে টানাটানিতে ওর পাপড়িগুলো খসে পড়েছে। বর্ণ, গন্ধ সব গেছে। আমিও পড়েছি। মালার্মে, বোদলেয়ার, রিলকে। এদিকে ধরুন নেরুদা, হাইনে, লোরকা। কিন্তু যে কবি তার সমকালীন সমাজের কথা ভাবেন না, সমাজের প্রান্তিক মানুষের মঙ্গলের কথা লেখেন না, তার লেখা জনগণ ছেঁড়া পাতার মতই ছুঁড়ে ফেলে দেবে। ইতিহাসই তার সাক্ষী।

ঋক সেদিন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছিল আফ্রিকার প্রতিবাদী সাহিত্য, দক্ষিণ আমেরিকার বিপ্লবী সংস্কৃতির লড়াই, ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সাহিত্যের সদর্থক ভূমিকা – এমনই আরও কত কথা। সেদিন মনে কোনও প্রশ্ন জাগেনি। সেদিন ঋক সেনগুপ্ত কতটুকুই বা জানত? দু’টো কবিতা লিখেছি বৈ নয়। কিন্তু আজ কত প্রশ্ন মনে ভিড় করে আসে। বুকের গভীরে বিশ্বাস যেন একটু টাল খেয়ে যায়। পার্টির প্রতি আনুগত্য এখনও প্রশ্নাতীত, কিন্তু কিছু প্রশ্নের জবাব সে সংহিতাকে দিতে পারছে না। দিলেও এমন ভাসা-ভাসা, নিজের কাছেই লজ্জায় পড়ে যায় ঋক। সংহিতার সে সব অমোঘ প্রশ্নের ব্যাখ্যা ঋকের নিজের কাছেই পরিষ্কার নয়।

‘আচ্ছা, তোমরা কি কোনওদিন খোলস ভাঙবে না? বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ, না বৈজ্ঞানিক জড়বাদ? ঝর্ণা দেখতে পাও না তোমরা? বোঝ না এ দেশের মাটি আলাদা, মাটির সুর অন্য গ্রামে উচ্চারিত হয়? তোমরা পারলে ঝর্ণাকেও ডিওয়াই বাই ডিএক্স-এ ফেলতে চাও। সব কিছু পালটে যাচ্ছে। মানুষের ভাষা, বেঁচে থাকার মানে, আদর্শ, ভোগবাসনার সীমানা, ত্যাগের প্রবৃত্তি, বিভিন্ন দেশের ভেতরে স্বার্থের সমীকরণগুলো পালটে যাচ্ছে। অথচ তোমরা এখনও মানুষকে চিনতে চাও, তার শ্রেণিবিভাগ করো সেই আদ্যিকালের কাঠের স্কেল দিয়ে। কোনও দিন ভেবেছ ওই কাঠ আদৌ সিজন করা ছিল কিনা? দেশ-কাল-পাত্র ভেদে সব মাপবে ওই পুরনো স্কেল দিয়ে।’

সংহিতাকে আজ কথায় পেয়েছে। অন্যদিন গুনগুন করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। না হয় জীবনানন্দ বা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আবৃত্তি করে। সংহিতার গলায় কোনওদিন সুকান্তর কবিতা শোনেনি ঋক। আজ হঠাৎ সংহিতা যেন সংহার করবে বলেই কথার এই চিতেন, ঢিলা, কস্তাটানে ঋকের ঘুড়ি ভোকাট্টা করবে বলেই খেলা শুরু করেছে। ঋক যতই তার চাঁদিয়ালকে নীচে মাটির দিকে নামিয়ে আনে, ও তত ওপর-প্যাঁচ দেয়। নীল আকাশের দিকে টেনে ওঠায় ওর পক্ষীরাজ দিয়ে।

‘খোলসের পৃথিবী তোমাদের। ঘোট পাকাচ্ছ কুসুম আর সাদা অংশ দিয়ে। ভাবছ – এই তো সিদ্ধ হয়ে এলো প্রায়। না কি ভাবছ তা দিচ্ছে কেউ বাইরে থেকে। এই ডিম ফুটে বের হলাম বলে। কিন্তু যদি কোনওদিন সেই ভয়ঙ্কর কথাটা শোনো যে আদৌ কেউ তা দিচ্ছে না। এই খোলসের জগৎই তোমাদের অনন্তকালের পৃথিবী, সেই সত্য সহ্য করতে পারবে তো?’

ঋক হেসে ফেলল। হুবহু গুন্টার গ্রাসের কবিতা। হলেও, সংহিতা ভালো প্রয়োগ করেছে। আর, যদি সংহিতা সেই কবিতা নাও পড়ে থাকে, তবে কী করে এমন হুবহু মিলে যায়। বুকের ভেতরে ছোট্ট চিড় ধরে ঋকের।

‘কেন, আমরা কি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য আমাদের কর্মসূচি পাল্টাইনি?’

‘কর্মসূচি? ও হ্যাঁ, তাই তো। রবীন্দ্রনাথকে তোমরা এখন আর বুর্জোয়া কবি বলছ না। জীবনানন্দের ইতিহাস-চেতনার নব মূল্যায়নও তোমাদের পরিবর্তিত কর্মসূচির অঙ্গ নিশ্চয়?’

‘ব্যাপারটা তুমি অন্য অ্যাঙ্গেলে দেখছ কেন? আসলে এই আর্থ-সামাজিক কাঠামোয়…’

‘ব্যস ব্যস। তা এই কাঠামোটা বদলাবার জন্য তোমাদের পরিবর্তিত কর্মসূচি কী কী? চাঁদ, ফুল, তুমি, আমি দিয়ে আর কবিতা লেখা চলবে না?’

ঋক জানে সংহিতার প্রধান দুর্বলতা কোথায়। রবীন্দ্রনাথ সংহিতার সব চেয়ে বড় দুর্বল জায়গা। ওখানে সামান্য আঘাত লাগলেও সে আগুনের মত জ্বলে ওঠে। বাইরের সবাই ওকে চেনে সফল আবৃত্তিকার হিসেবে। একবার বাংলাদেশেও ঘুরে এসেছে। কিন্তু অসাধারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় সংহিতা। ওর মায়ের কাছে রীতিমত তালিম নিয়ে শেখা। ওর মা শিখেছে সঙ্গীত-ভবনে। রবীন্দ্রনাথ ওদের বংশের সবার রক্তেমজ্জায় মিশে আছে। সংহিতা যদি প্রফেশনাল গাইয়ে হ’ত, তা হলেও নাম করত।

‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিভার একশ শতাংশ আমাদের হিসেবে সদর্থে প্রয়োগ করেননি’ – ঋক একদিন কথায় কথায় বলেছিল।

‘ও হ্যাঁ, তাই তো। হাজার হাজার শব্দ, অথচ ‘লাল’ শব্দটা খুঁজেই পাওয়া যায় না।’

কী কথার কী উত্তর। এমন অন্ধ আনুগত্যের সঙ্গে যুক্তি দিয়ে তর্ক করা যায় না। হতাশ হয়েছিল ঋক। সংহিতার যে ক’টি প্রিয় গান, তার মাঝে একটি গাইতে বসলে ঠিক কাঁদবেই। মাঝে মাঝে তব দেখা পাই/ চিরদিন কেন পাই না…। ক্বচিৎ এটি গাইত সংহিতা, কদাচিৎ। বড় সুন্দর সংহিতার উচ্চারণ। আজকাল যখন অনেকেরই উচ্চারণ শোনা যায় ‘রিদয়’। তখন সংহিতার মন্দ্র ‘হৃদয়’ এক ব্যাপ্তি আনে। শব্দের অন্তর্গত বোধ তার উচ্চারণকে অতিক্রম করে অন্য মাত্রা আনে। বা ‘মেঘে’ ঘ-এর অভিঘাত শব্দের আটপৌরে ক্লিশে অর্থকে ছিন্ন করে। গান থেমে যাওয়ার পরও তানপুরার সরুমোটা তারের অনুরণন তার আবেশ ছড়িয়ে রাখে ঘরের অন্ধকারে। ঋক স্পষ্ট টের পায় সংহিতার চোখ মোছা।

সংহিতার আর এক দুর্বলতা ঋকের কবিতা। সফল কবি হিসেবে আজ যে জায়গায় ঋক এসে পৌঁছেছে, ঋক জানে সেই সাফল্যের পঞ্চাশ ভাগ সংহিতার প্রাপ্য। প্রতিটি অনুষ্ঠানে ঋকের কবিতা পাঠ করে সংহিতা। এখনও। ঋক অবাক হয়ে শোনে দৃপ্ত, সাবলীল ওঠানামায় তার কবিতায় প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করে সংহিতা। সে বিস্মিত হয় – এ কবিতা কি আমার? এ কি আমারই সৃষ্টি। জনপ্রিয়তার নিরিখে যদি বিচার করা যায়, তবে ঋক জনপ্রিয় কবি। কিন্তু একটা ব্যাপার ঋক খেয়াল করেছে তার কিছু কবিতা সংহিতা কখনই পাঠ করে না। অথচ ওই কবিতাগুলোতেই তার গোপন রক্তপাত বেশি।

কলকাতায় মহামিছিলে অংশ নিয়ে ফেরার পথে অ্যাক্সিডেন্ট হলো। পদচ্যুত হ’ল ঋক। ঋকের ডান পা হাসপাতালে রেখে আসতে হলো। সংহিতা তখন কলেজের চাকরিটা পেয়েছে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার ছ’মাসের মধ্যে সংহিতার তাগিদে বিয়ে হলো ওদের।

‘অন্নচিন্তা তোমাকে করতে হবে না। এখন শুধু কবিতা লিখবে তুমি।’

ক্রাচটা ঋকের দিকে এগিয়ে সংহিতা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।

‘আর তুমি?’ ম্লান হাসে ঋক।

‘আমি? নাচব, খেলব, গাইব। ওরে বকুল পারুল, শাল পিয়ালের বন…’

সত্যি সত্যি কোমরে আঁচল জড়িয়ে একপাক নেচে ওঠে সংহিতা। ঋক ঠিক বুঝে উঠতে পারে না এ কি সংহিতার সত্যিকারের আনন্দ, না কি তাকে স্বাভাবিক রাখার মিথ্যে নাচের খেলা।

‘অ্যাই, তুমি আবার নাচতে যেও না যেন। আমার এক ঠেঙে কবি। বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ বলে ঘূর্ণনে বস্তুর মধ্যে এক প্রকার আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, তার ফলে পরিপার্শ্ব সম্পর্কে ভ্রম জন্মায়। ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়। সুতরাং, সাবধান।’

‘সংহিতা, অমিতাভদাকে বলে খবরের কাগজের চাকরিটা আবার চেষ্টা করব?’

‘ও, তিনি তো আবার তোমাদের কেমন আত্মীয়, তাই না?’

কিন্তু ঋক সেনগুপ্ত আজকাল কেমন পালটে যাচ্ছে। ক্রাচ নিয়ে মিটিংমিছিলে যেতে কষ্ট হয়। সংহিতাও যেতে দেয় না। ঘরে বসে কবিতা লিখতে বলে শুধু। সংহিতা বোঝে না মিছিলের মুখ না দেখলে তার লেখা আসে না। সংহিতা বোঝে না গভীর রাতে ট্রেনের জানালা দিয়ে জ্যোৎস্নায় ধুয়ে-যাওয়া শিশিরমাখা নদী দেখতে না পেলে কবিতা হয় না। মানুষের মুখ দেখতে না পেলে কবিতা আসে না। চার দেওয়ালে বন্দী এই ঘরে, এই বিছানায় শুয়ে শুধু পার্টির দলিল পড়া যায়। শুধু ইশ্তেহার।

কলেজ থেকে ফিরে সংহিতা দ্যাখে ডাইরির শূন্য পাতা, অলস পেন পড়ে আছে টেবিলের নীচে।

‘কী গো, সেই কবিতাটা শেষ করনি? শরীর খারাপ নাকি?’ সংহিতা ঋকের কপালে হাত দিয়ে টেম্পারেচার বোঝার চেষ্টা করে। নর্মাল। নিচে ক্লাবের ছেলেরা গাড়ির হর্ন বাজায়। আজ তরুণতীর্থ ক্লাবের রজতজয়ন্তীর উদ্‌ঘাটন সমারোহ।

ঋক চুপচাপ শুয়ে থাকে। ভেতরের ফাটলগুলো একবার জোড়া লাগে, আবার হা হা করে খুলে যায়। ব্যথায় নীল হতে থাকে ঋক। শুয়ে শুয়ে দেখতে থাকে গায়ের চামড়ার রং পাল্টাচ্ছে নাকি। শুঁড় নাড়িয়ে বাতাসের তাপমাত্রা মাপার চেষ্টা করে। খোলস পাল্টাবে কিনা ভাবতে থাকে।

ফরফর করে আরশোলাগুলো উড়ছে। সংহিতা আজ সকালেই রবীন্দ্রনাথের ছবিটা নামিয়েছে। ফুলের মালা গেঁথেছে। আজ সারাদিন সংহিতা একটা ঘোরের মধ্যে থাকবে। আজ পঁচিশে বৈশাখ। কাল তানপুরার তারগুলো পাল্টেছে। অনেকদিন জোয়ারি করা হয়নি। মায়ের স্মৃতি – সাড়ে তিন অক্টেভের ডোয়ারকিনের হারমোনিয়াম ঝেড়েমুছে পরিষ্কার করতে গিয়ে আজ এই বিপত্তি। আরশোলা ভীষণ ভয় পায় সংহিতা। ঘেন্না হয় তার। যুগ যুগ ধরে অবিকল রয়ে গেল। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে কী সুন্দর খাপ খাইয়ে নিচ্ছে পেরিপ্লানেটা আমেরিকানা।

মুখ থেকে আঁচল সরিয়ে সংহিতা ছদ্ম রাগে ধমকে ওঠে ঋককে – ‘দেখছ কী, তাড়িয়ে দাও না ওগুলো।’

সম্মোহিতের মত ঋক তাকিয়েছিল মেঝের ওপর। ওই খয়েরি রঙের পতঙ্গের দিকে। কী রেশম-মসৃণ রং।

‘তখন থেকে কী দেখছ বলো তো?’

‘জনগণ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জনগণ। একটা দুটো খোলস পাল্টাবে এখন।‘

‘থাকো তুমি তোমার জনগণ নিয়ে।’

‘তুমি?’ ঋক জানতে চায়।

সংহিতা সমস্ত ভয় জয় করে উঠে দাঁড়ায়। সকালে চন্দন ঘষে রেখেছিল। একটা দেশলাই কাঠি দিয়ে ছবির ওপর টিপ পরায়।

‘আমার রবীন্দ্রনাথ আছে।’

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *